লেনদেনে স্বচ্ছতার গুরুত্ব
আবদুল্লাহ হাসান কাসেমি
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
প্রত্যেক মানুষ পরনির্ভরশীল। তাই সমাজবদ্ধ জীবনে একে অপরের শরণাপন্ন হতে হয়। নানা প্রয়োজনে লেনদেন করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় পারস্পরিক এ লেনদেনই বিবাদ, দূরত্ব ও সম্পর্ক ছেদন এবং মনোমালিন্যের কারণ হয়। এমনকি এর সূত্র ধরে মারামারি-কাটাকাটি পর্যন্ত গড়ায়। এর বহু কারণ থাকতে পারে। তবে অন্যতম কারণ হচ্ছে, লেনদেনের অস্বচ্ছতা; যা আজ সাধারণ-বিশিষ্ট সবার মাঝে প্রকটভাবে নজরে পড়ছে। বস্তুত স্বচ্ছ ও নিখুঁত লেনদেন দিনদিন সোনার হরিণে পরিণত হচ্ছে। অথচ বিবাদমুক্ত সুখী-সুন্দর জীবনের জন্য ধার্মিকতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নির্মলতা।
ধার্মিকতার মাপকাঠি : লেনদেন হচ্ছে ধার্মিকতার মাপকাঠি। একজন মানুষের মাঝে কতটুকু ধার্মিকতা আছে, তা জানা যায় এর মাধ্যমে। এ জন্যই বলা হয়, প্রকৃত দ্বীনদারি লেনদেনের নাম। অর্থাৎ খুব নামাজ পড়া, লাগাতার রোজা রাখা, একের পর এক হজ-ওমরা করা, দান-সদকায় আগে আগে থাকা, জিকির, তেলাওয়াত ও তাসবিহ নিয়ে পড়ে থাকা শুধু দ্বীনদারি নয়, প্রকৃত দ্বীনদারি হলো, একজন মানুষ এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় লেনদেনেও স্বচ্ছ ও সতর্ক হবে। মিথ্যার আশ্রয় নেবে না, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না, আমানতের খেয়ানত করবে না এবং দেনাপাওনা পরিশোধেও গড়িমসি করবে না। কিন্তু অনেকে নামাজ-রোজা, জিকির-তেলাওয়াত ও তাসবি-তাহলিলকেই দ্বীনদারি ধরে নিয়েছে। তাই তাদের নামাজ-কালামে ও লেবাস-পোশাকে বড় দ্বীনদার মনে হলেও লেনদেনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মস্ত বড় ধূর্ত। যার লেনদেনে অস্বচ্ছতা, পাওনা পরিশোধে টালবাহানা ও অসতর্কতা চোখে পড়ে।
লেনদেনেই বোঝা যায় দ্বীনদারি : বাহ্যিক চালচলন, বেশভূষা দেখে কাউকে প্রকৃত দ্বীনদার ভাবার সুযোগ নেই। জনৈক ব্যক্তি ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর কাছে এক ব্যক্তির গুণকীর্তন করে বলল, ‘অমুক বড় সত্যবাদী।’ ওমর (রা.) বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি কি তার সঙ্গে কখনও সফর করেছ?’ লোকটি উত্তর দিলো, ‘জ্বী না।’ ওমর (রা.) আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তাহলে কি তোমার ও তার মাঝে কখনও কোনো লেনদেন হয়েছে?’ লোকটি একই উত্তর দিল, ‘জ্বী না।’ ওমর (রা.) তৃতীয়বার প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, তাহলে কি তুমি কখনও তার কাছে কোনো আমানত রেখেছ?’ এবারও লোকটি নেতিবাচক উত্তর দিল। ওমর (রা.) বললেন, ‘না, তার ব্যাপারে তোমার কোনো ধারণাই নেই। মনে হয়, তুমি তাকে মসজিদে রুকুণ্ডসেজদা করতে দেখেছ! অর্থাৎ শুধু মসজিদের গণ্ডিতে দেখেই যে তাকে ধার্মিক ও সত্যবাদী মনে করছ এবং তার গুণের তারিফ করছ, এটা ঠিক নয়। প্রকৃত পরিচয় তো জানবে লেনদেনের পর।’ (কানজুল উম্মাল : ২৫৫৭০)।
আমলের রক্ষাকবচ : স্বচ্ছ লেনদেন যাবতীয় আমলের রক্ষাকবচ। কেননা, লেনদেন অস্বচ্ছ হলে এবং অন্যের হক অনাদায় থেকে গেলে আমলের বিরাট সঞ্চয়ও শেষ হয়ে যাবে। নিক্ষিপ্ত হতে হবে জাহান্নামের অতল গহ্বরে। একদিন রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে বললেন, ‘তোমরা কি জানো, নিঃস্ব কে?’ সবাই উত্তর দিলেন, ‘আমাদের মাঝে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যার কাছে টাকা-পয়সা, ধনসম্পদ কিছুই নেই।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘না, আমার উম্মতের মাঝে প্রকৃত নিঃস্ব ওই ব্যক্তি, যে কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি আমল নিয়ে আসবে; কিন্তু দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারও রক্তপাত ঘটিয়েছে, কাউকে প্রহার করেছে। তাই তার নেক আমল থেকে একে একে হকদারকে দেওয়া হবে। আর যদি হক পরিশোধের আগেই আমল শেষ হয়ে যায়, তাহলে হকদারদের পাপ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম : ২৫২১)।
শহিদও ধরা পড়বে : লেনদেনে অস্বচ্ছতার কারণে আল্লাহর রাস্তায় শাহাদতের অমিয় সুধা পানকারী মুজাহিদও আটকা পড়ে যাবে। আবু কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি যদি আল্লাহর রাস্তায় ধৈর্য ধরে প্রত্যাশা নিয়ে শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ লড়াই করতে করতে নিহত হই, তাহলে কি আল্লাহতায়ালা আমার পাপসমূহ মোচন করে দেবেন?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ এরপর লোকটি যখন ফিরে যেতে লাগল, তখন রাসুল (সা.) তাকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী বললে যেন?’ লোকটি পূর্বোক্ত কথা বলল। নবীজি (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, তবে ঋণ ছাড়া। এভাবেই জিবরাইল (আ.) আমাকে বলে গেলেন।’ (সুনানে নাসাই : ৩১৫৬)।
