স্বাবলম্বিতায় সুখ ও সফলতা
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘স্ব-অবলম্বন’ থেকে ‘স্বাবলম্বন’ শব্দটি এসেছে। মানুষ যে মাটিতে আছাড় খায়, সেই মাটি ধরেই আবার সে উঠে দাঁড়ায়। এটাই স্বাবলম্বনের সহজ প্রকাশ। স্বাবলম্বী সেই ব্যক্তি, যে তার মেধা, যোগ্যতা- সর্বোপরি তার মহামূল্যবান মস্তিষ্কের ওপর আস্থা রাখে। অলৌকিকভাবে তাকে সাহায্য করা হবে, এমন অলিক কল্পনা সে করে না। নিজের দায়িত্ব সে নিজে নেয়। এমনকি আশপাশের দায়িত্বও সে নিয়ে নেয়। স্বাবলম্বী মানুষ শূন্য থেকে শুরু করে; কিন্তু ধাপে ধাপে তার কাজ পূর্ণতা পায়। ইসলামে স্বাবলম্বিতা বা আত্মনির্ভরশীলতাকে অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও মর্যাদাপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়। এটি কেবল জাগতিক বিষয় নয়, বরং ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ।
স্বাবলম্বী জীবনই সফল জীবন : একবার ইন্টারভ্যু বোর্ডে এক লোক নোংরা পোশাক পরে এলো। ইন্টারভ্যুয়ার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার পোশাক এত নোংরা কেন?’ সে বলল, ‘আমার কাজের ছেলেটা ছুটিতে আছে। আর আমার মা আমাকে শেখাননি যে, কীভাবে কাপড় পরিষ্কার করতে হয়!’ যারা নিজের বিছানা নিজে গোছাতে পারে না, নিজে সময়মতো ঘুম থেকে জাগতে পারে না, নিজের জুতা ঠিক জায়গায় রাখতে পারে না, যার পানিটাও অন্যকে ঢেলে দিতে হয়, সে আসলে জীবনযুদ্ধে অন্য অনেকের চেয়ে পিছিয়ে থাকে। অথচ পৃথিবীর অন্যতম সফল মানুষ রাসুলুল্লাহ (সা.) শৈশব থেকেই ছিলেন একজন স্বাবলম্বী মানুষ। যিনি জীবনে বাবার মুখ দেখেননি। ছয় বছর বয়সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাকে হারিয়েছেন। নয় বছর বয়সে দাদাও মারা গেলেন। এরপর চাচার কাছে লালিত-পালিত হন। এতিম শিশুকে চাচা মেষ চরাতে দিতে চাননি। কিন্তু সেই বালক নিজেই বেছে নিলেন মরুভূমিতে মেষ চরানোর মতো পরিশ্রমসাধ্য কাজ। একেবারে শৈশবেই তিনি ছিলেন পরিশ্রমী আর কর্মঠ। তরুণ বয়সে মরুভূমির দীর্ঘপথ, পানির তৃষ্ণা, যাত্রার কষ্ট থাকা স্বত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণিজ্যের উদ্দেশে যাত্রা করলেন এবং সফল হলেন। নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার যে আগ্রহ, সেটাই তাকে মহিমান্বিত করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামের প্রথম মসজিদ নির্মাণের সময়ও সবার সঙ্গে মাটি কাটায় অংশ নিয়েছেন, মাটি বহন করেছেন। তাই তো পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বত্র তিনি সফল হয়েছেন।
ইসলামে স্বাবলম্বিতার গুরুত্ব : মুসলমানরা পরকালে বিশ্বাস করে; এর অর্থ এ নয়- দুনিয়ায় স্বাবলম্বিতার দরকার নেই। বরং একজন মুসলমানের জন্য দুনিয়ার কল্যাণ ও পরকালের কল্যাণ- উভয়টিই প্রয়োজন। কোরআনে মহান আল্লাহ বান্দাকে স্বাবলম্বিতার দোয়া শিখিয়েছেন, ‘হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দিন এবং পরকালেও কল্যাণ দিন।’ (সুরা বাকারা : ২০১)। দুনিয়াবি কল্যাণের জন্য সম্পদে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার তাগিদ রয়েছে। তাই সম্পদ খরচের ক্ষেত্রে কৃপণ হওয়া যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি প্রাচুর্যের সময় অপচয়-অপব্যয় করে সম্পদ খরচ করাও নিষেধ। কোরআনে অপচয় ত্যাগের কঠোর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পানাহার কর, কিন্তু অপচয় করো না। আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩২)। আল্লাহ আত্মনির্ভরশীলদের ভীষণ ভালোবাসেন। সাদ (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এ কথা বলতে শুনেছি, ‘মহান আল্লাহ মুত্তাকি, আত্মনির্ভরশীল ও লোকালয় থেকে নির্জনে বাসকারী বান্দাকে ভালোবাসেন।’ (মুসলিম : ৭৩২২)।
সম্পদ রেখে ইহকাল ত্যাগ করা উত্তম : সন্তানের জন্য কিছু সম্পদ রেখে মৃত্যুবরণ করা উত্তম। সাদ ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত; বিদায় হজের বছর আমি ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হই। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে দেখতে আসেন। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার রোগ কী পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা আপনি দেখতে পাচ্ছেন। আমি একজন সম্পদশালী। আমার ওয়ারিশ আমার একটি মাত্র কন্যা। আমি আমার সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ আল্লাহর পথে সদকা করে দেব?’ তিনি বললেন, ‘না।’ আমি বললাম, ‘তবে কি অর্ধেক?’ তিনি বললেন, ‘হে সাদ! এক-তৃতীয়াংশ দান কর। এটাই অনেক বেশি। তুমি তোমার সন্তানকে সম্পদশালী রেখে যাওয়া উত্তম এমন অবস্থার চেয়ে যে, তুমি তাদের নিঃস্ব রেখে গেলে। ফলে তারা অন্যের কাছে ভিক্ষা করে।’ (বোখারি : ৩৯৩৬)।
কর্তব্য পালনে স্বাবলম্বিতার তাৎপর্য : সম্পদে স্বাবলম্বী হলে অন্যের হক আদায় করা যায়। পরিবারের ব্যয়ভার বহন করা যায়। দান-সদকা, জাকাত, হজ, মসজিদ নির্মাণ ইত্যাদি আর্থিক ইবাদত পালন করা যায়। যে পরমুখাপেক্ষিতা থেকে বাঁচতে চায় এবং এর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে, মহান আল্লাহ তাকে স্বাবলম্বী করে দেন। হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ওপরের হাত (দাতার হাত) নিচের হাত (গ্রহীতার হাত) থেকে উত্তম। প্রথমে তাদের দেবে, যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তুমি বহন কর। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে সদকা করা উত্তম। যে ব্যক্তি (পাপ ও ভিক্ষা করা থেকে) পবিত্র থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখেন এবং যে পরমুখাপেক্ষিতা থেকে বেঁচে থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে স্বাবলম্বী করে দেন।’ (বোখারি : ১৪২৭)।
স্বাবলম্বনের সহজ ভিত্তি ও উপায় : কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্বাবলম্বনের ভিত্তি কৃষি। এ দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর। কৃষিকে উপেক্ষা করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অসম্ভব। কৃষি উন্নয়নে সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রসরতার তাগিদে আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন, সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের সুযোগ নিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে যথার্থ আত্মনিবেদন। ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যায় স্বনির্ভরতা জরুরি। এমতাবস্থায় কৃষিক্ষেত্রে চাপ বাড়ছে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা কৃষির মান উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষিজাত উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রযুক্তিবিদ্যায় সাফল্য ও সুফলকে কাজে লাগিয়ে দেশের অনেক শিক্ষিত বেকার আজ স্বাবলম্বী, প্রতিষ্ঠিত।
বেকারত্ব দূর করতে চাকরির মোহ ত্যাগ করে তারা নানাভাবে কৃষি, মৎস্য উৎপাদনে নিয়োজিত। আজকাল অনেক শিক্ষিত যুবক-যুবতী সরকারি চাকরির পেছনে ছুটে ক্লান্ত। তারা অনেকেই ভুলে যায়, সীমিত সরকারি ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত চাকরি দেওয়া বা পাওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি কার্যকরী ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে চলছে। তথাকথিত শিক্ষিতদের বাদ দিলেও গ্রামীণ মানুষের যথার্থ যোগদান প্রতিকূল অবস্থাতেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ শিক্ষিত যুবকেরা অনেকাংশে কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রতি ঝুঁকছে। তারা স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে। কৃষিক্ষেত্রে তাদের অবাধ যোগদান দেশকে অবশ্যই ভবিষ্যতে উন্নত দেশের মর্যাদা দিতে পারে। কারণ, কৃষিকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী
