পৃথিবীর ব্যাংকিং জগতে ইসলামী ব্যাংকিং একটি বিপ্লবের নাম। মুসলিম দেশগুলোর সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীর অমুসলিম দেশগুলোয়ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ইসলামী ব্যাংকিং আজ এতটাই জনপ্রিয় যে, আটটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক তো আছেই, ১৭টি ব্যাংক প্রচলিত (কনভেনশনাল) ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর বাইরে ডজন খানেকেরও বেশি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে।
বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকগুলোয় বহুল প্রচলিত বিনিয়োগের ধরন হলো কেনাবেচা (বাই’)। বাই’ বা কেনাবেচার মধ্যেও সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো মুরাবাহা। মুরাবাহা শব্দের উৎপত্তি ‘রিবহুন’ থেকে। এর আভিধানিক অর্থ হলো অতিরিক্ত, বাড়তি, লাভ ইত্যাদি। (আল ফিকহু আলা মাজাহিবিল আরবাআ, ২/১২০)। পরিভাষায় মুরাবাহা হলো কোনো পণ্য ক্রয়ের পর ক্রয়মূল্যের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ সংযোজন করে তা বিক্রি করা। যেমনÑ কারও একটি গাড়ি প্রয়োজন। তিনি গাড়িটি ক্রয় করতে ব্যাংক থেকে সুদি ঋণ না নিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে এ মর্মে চুক্তি করল যে, ব্যাংক গাড়িটি ক্রয় করে ক্রয়কৃত মূল্যের ওপর ১০ শতাংশ মুনাফায় তা তাকে সরবরাহ করবে। সুদি ঋণ থেকে বাঁচার জন্য মুরাবাহা হলো একটি বিকল্প পন্থা। হাদিসে এমন কেনাবেচার বৈধতার প্রমাণ রয়েছে।
মুরাবাহার ক্ষেত্রে গাহককে শুধু পণ্যই সরবরাহ করা যাবে। যদি পণ্য না দিয়ে গ্রাহকের হাতে টাকা দিয়ে দেয়, তাহলে তা অর্থায়নে পরিণত হয়ে যাবে। অথচ মুরাবাহা কোনো অর্থায়ন পদ্ধতি নয়; বরং তা হলো বিশেষ প্রকারের ক্রয়-বিক্রয়। ইসলাম অর্থায়নের যেসব পদ্ধতির পথ খোলা রেখেছে, তা হলো ‘মুদারাবা’ ও ‘মুশারাকা’। কয়েকজনের পুঁজি যৌথভাবে খাটিয়ে যে লাভ হয়, তা নিজেদের মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত হারে বণ্টন করে নেওয়াই মুশারাকা। আর মুদারাবা হলো এক পক্ষের মূলধন আরেক পক্ষের শ্রমের সমন্বয়ে ব্যবসা করে যে লাভ হয়, তা পূর্বনির্ধারিত হারে বণ্টন করে নেওয়া। এ নিয়মে অর্থায়ন করলে ব্যাংক হবে সাহিবুল মালের (অর্থের জোগানদাতা) ভূমিকায়। আর মুরাবাহা ভিত্তিতে বিনিয়োগ করলে ব্যাংকগুলো হবে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায়। সাধারণ ব্যাংকগুলো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অর্থায়ন করলে তা থেকে সুদ গ্রহণ করে থাকে। এতে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের লোকসান হলেও ব্যাংককে দিতে হবে সুদ। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে অর্থায়নের যে সুযোগ রয়েছে তাতে নির্দিষ্ট হারে লাভ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং তা হলো পুঁজি খাটিয়ে যে লাভ হয়, তা পূর্বনির্ধারিত হারে বণ্টন করে নেওয়া। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক যদি কোনো প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ টাকা দেয়, তাহলে এর বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে কোনো লাভ নিতে পারবে না। বরং সে প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করে যে মুনাফা অর্জন করবে, তা থেকে পূর্ব নির্ধারিত হারে ব্যাংক মুনাফা নেবে। প্রতিষ্ঠানের লাভ বেশি হলে ব্যাংকও হার অনুযায়ী বেশি পাবে। কম হলে কম পাবে। না হলে কোনো মুনাফাই পাবে না। লোকসান হলে তাও মেনে নিতে হবে ব্যাংককে। মুরাবাহার শর্ত না মানায় ক্রয়বিক্রয় যদি অর্থায়ন হয়ে যায়, তাহলে এ থেকে নির্দিষ্ট হরে লাভ করায় তা সুদে পরিণত হতে বাধ্য। মুরাবাহা বিক্রি নগদেও হতে পারে বাকিতেও হতে পারে। নগদে মূল্য পরিশোধ করলে ক্রয়মূল্যের ওপর শতকরা যত টাকা লাভ সংযোজন করা হবে বাকিতে মূল্য পরিশোধ করলে তাতে সংযোজিত লাভের হার অবশ্যই বেশি ধার্য করা যাবে।
মুরাবাহার শর্তগুলো পূর্ণভাবে অনুসরণ না করা হলে সামান্য কারণেই তা পরিণত হবে সুদে। তাই মুরাবাহার পূর্ণ অনুশীলন প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায় মুরাবাহার অনুশীলন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। গ্রাহক কিছু ভাউচার জমা দিয়ে দেয়, আর ব্যাংক তাকে টাকা দিয়ে দেয়। গ্রাহকের হাতে যদি পণ্য না দিয়ে টাকা দেয়, তাহলে তা কেনাবেচা না হয়ে হবে অর্থায়ন। এটি হবে মুরাবাহার নামে প্রতারণা।
অনেক সময় বাস্তবে মুরাবাহা চুক্তি হলেও ক্রয়কৃত পণ্যটি ব্যাংক নিজের দখলে না নিয়ে কোম্পানি থেকেই তা গ্রহককে সরবরাহ করে দেয়। এটিও মুরাবাহাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিশ্চিতভাবে। কারণ, ক্রয়বিক্রয় বৈধ হওয়ার জন্য ওই পণ্যে বিক্রেতার মালিকানা প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। আবার অনেক সময় ব্যাংক মুরাবাহায় বিনিয়োগ করতে গিয়ে গ্রাহককে প্রদেয় পণ্যটির মূল্য যা হয়, সেই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করার পর ব্যাংক নিজে ওই পণ্যটি ক্রয়ের ঝামেলা এড়াতে গিয়ে খোদ গ্রাহককেই তা ক্রয়ের জন্য উকিল (প্রতিনিধি) নিয়োগ করে। এবং গ্রাহকও সে পণ্যটি ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে ক্রয় করে ব্যাংককে তা বুঝিয়ে না দিয়েই গ্রাহক হিসেবে তা নিজের দখলে নিয়ে নেয়। এটিও জায়েজ নয়। হ্যাঁ, যদি গ্রাহক উকিল (প্রতিনিধি) হিসেবে ক্রয়ের পর তা ব্যাংককে বুঝিয়ে দেয়, ব্যাংকও তা গ্রাহকের কাছ থেকে বুঝে নেয়। উকিল হিসেবে তার দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর ব্যাংক তাতে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে পুনরায় যদি গ্রাহকের সঙ্গে ইজাব-কবুলের মাধ্যমে তার মুরাবাহা সম্পন্ন করে তাহলে তা জায়েজ হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কেউ কোনো জিনিস ক্রয় করার পর তা ভালোভাবে মেপে হস্তগত করার আগেই যেন তা বিক্রি না করে।’ (আবু দাউদ : ৩/২৯৯)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন কেউ কোনো খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ের পর তা কব্জ না করে, যেন অন্যত্র বিক্রি না করে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এ ক্ষেত্রে সব জিনিস খাদ্য দ্রব্যের মতোই। (বোখারি : ২/৭৫০; মুসলিম : ৫/৭)।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে গ্রাহকের কাছ থেকে কোনো পণ্য ক্রয় করে আবার তারই কাছে তা অধিক মূল্যে বিক্রি করা হয়। যেমন ব্যাংক আবদুল্লাহর কাছ থেকে একটি মোটরসাইকেল ৫০ হাজার টাকায় ক্রয় করে তারপর আবার আবদুল্লাহর কাছেই ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি করল। তা কিছুতেই বৈধ নয়। এছাড়া মোটরসাইকেলটি যখন ব্যাংক ক্রয় করে তখনই আবার বিক্রেতা (আবদুল্লাহর) কাছেই বিক্রি করার শর্তের কারণে প্রথম ক্রয়টিই অবৈধ হয়ে যাবে।
যথাসময়ে ঋণ অনাদায়ে সুদি ব্যাংকগুলো সুদকে আসলের সঙ্গে মিলিয়ে তার ওপর পরবর্তী মেয়াদের সুদ হিসাব করে থাকে। যতদিন ঋণ আদায় না করে, ততদিন চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়তে থাকে। পরিভাষায় যা রোল অভার (জড়ষষ ড়াবৎ) হিসেবে অভিহিত। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকিংয়ে এমনটির কোনো সুযোগ নেই। কারণ, কোনো পণ্যে মূল্য একবার নির্ধারণ করার পর সেই চুক্তি বিদ্যমান থাকা অবস্থায় পুনর্মূল্য নির্ধারণ করা জয়েজ নেই। (ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ন, পৃষ্ঠা-৪৭০)।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, গ্রাহকরাই কৌশলে অর্থায়নে বাধ্য করছে। ব্যাংক থেকে পণ্য গ্রহণ না করে সরাসরি টাকা গ্রহণের প্রবণতা কাজ করে। ইসলামী ব্যাংকিয়ের মূল লক্ষ্য হলো সুদের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। কিন্তু মুরাবাহায় পণ্য না নিয়ে কৌশলে টাকা নিলে মূল লক্ষ্যটিই ব্যাহত হবে। এতে তা আর সুদমুক্ত থাকবে না। বরং তা হয়ে যাবে সুদি ঋণ। তাই, মুরাবাহা কেনাবেচা পূর্ণ শরিয়াভিত্তিক করতে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেমন হতে হবে আন্তরিক, তেমনি গ্রাহককেও হতে হবে শরিয়াহ নীতির ব্যাপারে আন্তরিক।
লেখক : খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ
বোর্ড বাজার (আ. গণি রোড), গাজীপুর