আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য, আনুগত্যের জন্য। তিনি বলেন, ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানুষ ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।’ (৫১:৫৬) ইবাদত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা। আর সুস্থভাবে বাঁচার জন্য প্রয়োজন পৃথিবীতে বসবাসের নানা উপায়-উপকরণ। প্রয়োজন আবাসস্থল, খাবার, পোশাক ইত্যাদির। আর এগুলো সংগ্রহ করার জন্য প্রয়োজন অর্থ-সম্পদের। এ অর্থ-সম্পদ উৎপাদন, সরবরাহ, বিনিময়, বিতরণ ও ভোগ নিয়ে যে শাস্ত্র আলোচনা করে, তারই নাম অর্থনীতি বা অর্থব্যবস্থা। সম্পদ সীমিত; কিন্তু চাহিদা অফুরন্তÑ এই মৌলিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা আধুনিক অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু ইসলাম এর সঙ্গে একমত নয়। ইসলাম মনে করে, একজন মানুষের অফুরন্ত চাহিদা তাকে স্বার্থপর করে তোলে। তাই চাহিদা সীমিত করে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করাই ইসলামি অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য।
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও ইসলামি অর্থব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য প্রথমত দর্শনগত। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূল কথা হলো, প্রত্যেক ব্যক্তিই হবে তার নিজের উপার্জিত সম্পদের মালিক; তার সম্পদে অন্য কারও কোনো অংশ থাকবে না; তার ওপর অন্য কারও কোনো অধিকারও স্বীকৃত হবে না। এ ব্যবস্থায় মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন করা। তা যে কোনো উপায়ে হতে পারে, যে কোনো পরিমাণে হতে পারে। ঠিক তেমনি তা ব্যয় করারও কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। মানুষের তৈরি আইনের ভেতরে থেকে তা যে কোনো উপায়ে খরচ করা যেতে পারে। আবার চাইলে তা কুক্ষিগতও করে রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এক ব্যক্তি চাইলে মদ ও মৃত প্রাণীর গোশত বিক্রয় করে কোটিপতি হতে পারে। কিংবা সুদ আর ঘুষের সম্পদ মিলিয়ে গড়ে তুলতে পারে সম্পদের পাহাড়। আবার সে চাইলে তা মদ্যপান ও গর্হিত কাজে ব্যয়ও করতে পারে। এ অর্থব্যবস্থায় সম্পদ উপার্জনের কোনো নৈতিক আদর্শ যেমন নেই, তেমনি তা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও নেই কোনো নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ। এ ব্যবস্থা মানুষকে লোভী, স্বার্থপর ও হিংস্র করে তোলে। ভোগবিলাস ও সম্পদ উপার্জনকে জীবনের মূল লক্ষ্য স্থির করে দেয়। এ ব্যবস্থায় ধনী আরও ধনী হয়, আর দরিদ্র হয় আরও দরিদ্র।
পক্ষান্তরে ইসলাম আল্লাহর আনুগত্যকে মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য স্থির করে। ইসলাম বলে দেয় যে, সম্পদের মূল মালিক আল্লাহ তায়ালা। আল-কোরআনের বাণী : ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদের রিজিক হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর’Ñ (২:১৭২)। পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা হিসেবে মানুষকে তা সাময়িক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই সম্পদের মালিকানা অর্জন করতে হবে আল্লাহর সন্তোষজনক উপায়ে। আবার তা ব্যয়ও করতে হবে তাঁর নির্দেশিত পথে। এভাবে নির্দিষ্টসীমার মধ্যে থেকে সে যে কোনো পরিমাণ সম্পদ উপার্জন করতে পারে, আবার ব্যয়ও করতে পারে যে কোনো পরিমাণে। তবে তা কুক্ষিগত করে রাখা যাবে না। বরং সমাজের মানুষের উপকারে তা ব্যয় করতে হবে, কিংবা তা কোনো হালাল ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে হবে। তার সম্পদে অন্যের অধিকারও যথাযথভাবে স্বীকৃত হবে।
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা বল্গাহীন নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর অপরাপর মূলনীতি হলো :
এক. ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার : এ অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়াও উৎপাদনের নানা বিষয়ের ওপর মালিকানা লাভ করতে পারে।
দুই. উপার্জন অধিকারের স্বাধীনতা: ব্যক্তি এখানে যে কোনো উপায়ে যে কোনো পরিমাণে উপার্জন করার স্বাধীনতা ভোগ করে।
তিন. ব্যক্তিগত মুনাফাই কর্মপ্রেরণার উৎস : এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত মুনাফার জন্যই সম্পদ উপার্জনে উৎসাহী হয়। সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের জন্য নয়।
চার. প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা : এ ব্যবস্থায় পরস্পরের মধ্যে চরম প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। মুনাফা অর্জনে সবাই সরব ভূমিকা পালন করে।
পাঁচ. মালিক ও মজুরের পার্থক্য : এ অর্থব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দুই ভাগে বিভক্ত থাকেন। মালিক ও মজুর। ব্যবসায় যতই লাভ হোক, মজুর শ্রেণি তাদের নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকই পাবে। আবার ব্যবসায় ক্ষতি হলে তা শুধু মালিক শ্রেণিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ছয়. সুদি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা : সুদি ব্যাংক এ অর্থব্যবস্থার প্রাণ। বড় বড় ব্যবসা ও প্রজেক্টের মূলধনের ব্যবস্থা করে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নামমাত্র সুদ দিয়ে বড় অংকের মুনাফা করে। সাত. সম্পদের সুষম বণ্টন অনিশ্চিত : এ ব্যবস্থায় সম্পদের সুষম বণ্টনের কোনো কথা নেই। সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যক্তির থাকে বলে অন্য কাউকে সেখান থেকে ভাগ দিতে সে বাধ্য নয়।
আর ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূলনীতি হলো :
এক. অর্থাপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পার্থক্য করা : ইসলাম মনে করে সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে মানুষের অবাধ স্বাধীনতা নেই। বরং আল্লাহ যে উপায়ে উপার্জন করাকে হালাল করেছেন, শুধু সে উপায়েই উপার্জন করা যাবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ’Ñ (৪:২৯)।
দুই. সম্পদ কুক্ষিগত করতে নিষেধাজ্ঞা : ইসলাম মানুষকে ইচ্ছে মতো সম্পদ সঞ্চয় করে রাখতে নিরুৎসাহিত করে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাদের নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এ কার্পণ্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে; বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পণ্য করে সে সব ধন-সম্পদকে কেয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেনÑ আসমান ও জমিনের পরম স্বত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ সে সম্পর্কে ভালো করে জানেন’Ñ (৩:১৮০)। তিনি আরও বলেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আজাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন’Ñ (৯:৩৪)।
তিন. ব্যয়-বিনিয়োগের নির্দেশ : সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার পরিবর্তে ইসলাম নির্দেশ দেয় তা প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করার এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করার। আল্লাহ বলেন, ‘তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, তারা কি ব্যয় করবে? বলে দাওÑ যে বস্তুই তোমরা ব্যয় কর, তা হবে পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়-আপনজনের জন্য, এতিম-অনাথদের জন্য, অসহায়দের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। আর তোমরা যে কোনো সৎকাজই কর না কেন, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালোভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে’Ñ (২:২১৫)। তিনি আরও বলেন, ‘এবং তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক রয়েছে’Ñ (৫১:১৯)।
চার. সুদভিত্তিক বিনিয়োগ নিষিদ্ধ : পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মনে করা হয়, সম্পদ সুদভিত্তিক বিনিয়োগ করলে অতিরিক্ত মুনাফা হবে। ইসলাম তা অস্বীকার করে। আল-কোরআন ঘোষণা দেয়, ‘আল্লাহ তায়ালা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে’Ñ (২:২৭৬)। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এ আশায় তোমরা সুদে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা (জাকাত) দিয়ে থাকে, অতএব, তারাই দ্বিগুণ লাভ করে’Ñ (৩০:৩৯)। সুদভিত্তিক বিনিয়োগের কারণে সম্পদ একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির হাতে চলে যায়। গরিবের হাতে সম্পদ থাকে না। ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। যা বাজারের সামগ্রিক চাহিদা কমিয়ে দেয়। ফলে শিল্প-কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায় ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এক কথায়, পুরো অর্থব্যবস্থা থমকে দাঁড়ায়।
পাঁচ. পরস্পরকে সহযোগিতা করা : পরস্পরকে সহযোগিতা করা ইসলামি অর্থব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ বলেন, ‘যদি ঋণগ্রহিতা অভাবগ্রস্ত হয়, তবে তাকে স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেওয়া উচিত। আর যদি ক্ষমা করে দাও, তবে তা খুবই উত্তম যদি তোমরা উপলব্ধি কর’Ñ (২:২৮০)। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা নিভৃতে মানুষকে দান করতে উৎসাহিত করে বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতইনা উত্তম। আর যদি খয়রাত গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের গোনাহগুলো দূর করে দিবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্মের খবর রাখেন’Ñ (২:২৭১)।
ছয়. জাকাত : কারও কাছে প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ যদি থাকে, তাহলে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ অবশ্যই গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া ইসলামি অর্থব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের মালামাল থেকে জাকাত গ্রহণ কর, যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে’Ñ (৯:১০৩)।
সাত. মিরাস : ধন-সম্পদ সুষম বণ্টনের পরও যা অবশিষ্ট থাকে, মৃত্যুর পর তা ওয়ারিশদের মধ্যে সুষম বণ্টন করা ও ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইসলাম এ বিধান রেখেছে।
নায়েবে মুফতি, ইফতা বিভাগ, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ