পৃথিবীতে মানুষ আগমনের মাধ্যম হচ্ছে মা-বাবা। তাদের দাম্পত্য সম্পর্কের মাধ্যমে আমরা দুনিয়াতে আলোর মুখ দেখেছি। জন্মের আগে থেকেই তারা আমাদের ওপর অনুগ্রহকারী। জন্মের আগে মা গর্ভে ধারণের কষ্ট সয়েছেন। জন্মের সময় প্রসববেদনা মেনে নিয়েছেন। এত কষ্ট করে দুনিয়াতে নিয়ে আসার পর দেড় থেকে দুই বছর নিজের শরীরের এক অংশ আমাদের পান করিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমি মানুষকে স্বীয় সদাচারণের আদেশ দিয়েছি। (কারণ) তার মা তাকে কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে, কষ্ট করে জন্ম দিয়েছে। গর্ভধারণ ও দুধ পানের মোট সময় ৩০ মাস।’ (এই পুরো সময় সব ধরনের কষ্ট সহ্য করেছে।) (সুরা আহকাফ : ১৫)।
এটুকুই নয়, বরং নির্দিষ্ট একটি বয়স পর্যন্ত আমাদের জীবন ধারণের উসিলা হয়েছেন। সেটা না হলে হয়তো সূচনা লগ্নেই আমাদের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠত! হয়তো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যেত না। তাই তো তাদের এ অনুগ্রহের কথা আল্লাহ নিজের ইবাদতের পরই উল্লেখ করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার প্রভু নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারও ইবাদত করবে না। মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ করবে। তোমার জীবদ্দশায় যদি তাদের যে কোনো একজন বা উভয়জন বার্ধক্যে উপনীত হন তখন (তাদের কোনো কথায় বা আচরণে বিরক্ত হয়ে) উফ শব্দটিও বলো না। তাদের ধমক দিও না। (তথা তারা কষ্ট পাওয়ার মতো কোনো কথা বা কাজ যেন তোমার দ্বারা প্রকাশ না পায়।) বরং তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করো। তাদের সামনে দয়াবনত হয়ে বিনয়ের বাহু বিছিয়ে দাও। আর তাদের জন্য এ বলে দোয়া করো, হে প্রভু আপনি তাদের প্রতি দয়া করুন যেমন তারা আমাকে দয়া দিয়ে লালন পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৪)।
যাদের এত অনুগ্রহ আমাদের ওপর, নিশ্চয়ই আমাদের ওপর তাদের কিছু হক রয়েছে, দায়িত্ব রয়েছে। তার কিছু আদায় করতে হয় জীবিত অবস্থায় আর কিছু মৃত্যুর পর। জীবিত অবস্থায় দায়িত্বগুলো হলো এক. তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা। এরশাদ হয়েছে, আমি মানুষকে পিতা-মাতার সঙ্গে উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভধারণ করেছেন। তার দুধ ছাড়ানো দুই বছরে শেষ হয়েছে। আর আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রাখবে) পরিশেষে আমার কাছেই ফিরতে হবে, (সুরা লোকমান : ১৪)।
এমনকি পিতা-মাতা বিধর্মী হলেও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার বজায় রাখতে হবে। যতক্ষণ শরিয়তবিরোধী কোনো হুকুম না দেন, ততক্ষণ তাদের কথা মানতে হবে। এরশাদ হয়েছে, আর যদি পিতা-মাত তোমাকে এমন কাউকে আমার সঙ্গে শরিক করতে চাপ দেন যার ব্যাপারে তোমার জানা নেই, তাহলে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়ায় তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করে যাবে, (সুরা লোকমান : ১৫)।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, কুরাইশদের সঙ্গে সন্ধির দিনে আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার কাছে এলেন। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেসা করলাম, আমি কি তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, সদ্ব্যবহার কর, (বোখারি : ৩১৮৩)।
দুই. তাদের বাধ্য থাকা। পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা, তাদের সঙ্গে বেয়াদবি করা, কোনো কথায় বা কাজে তাদের কষ্ট দেওয়া জঘন্যতম অপরাধ। হাদিসে এসেছে, সবচেয়ে জঘন্য কবিরা গোনাহ হচ্ছে, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা। (বোখারি : ৫৯৭৩) অন্য হাদিসে আছে, পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে। পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি রয়েছে, (তিরমিজি : ১৯০৪)।
অনেকে আছে আবার সুন্দরী স্ত্রীর কথায় মা-বাবার অবাধ্য হয়, তাদের সঙ্গে বেয়াদবি করে। এটা কেয়ামতের অন্যতম এক আলামত। কেয়ামতের আলামত সংক্রান্ত হাদিসে আছে, কেয়ামতের আগে মানুষ বিবিদের কথা মান্য করবে এবং মায়ের নাফরমানি করবে। বন্ধু বান্ধবকে নিকটবর্তী করবে, পিতাকে দূরে সরিয়ে রাখবে, (তিরমিজি : ২২১৬)।
মাতা-পিতার অবাধ্যতার শাস্তি দুনিয়াতেও পেতে হয়। তার কোনো দোয়া কবুল করা হয় না। বর্ণিত আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা চাইলে বান্দার সব গোনাহ মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতার গোনাহ তিনি মাফ করবেন না। আর অবাধ্য সন্তানের সাজা তার মৃত্যুর আগে দুনিয়াতেই দেওয়া হবে, (মিশকাত : ৪২১)।
তিন. তাদের খেদমত করা। তাদের সন্তুষ্ট রাখা। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা তিনবার বললেন, তার নাসিকা ধুলোয় ধুসরিত হোক! সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি কার ব্যাপারে এসব বদ দোয়া করছেন? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা যে কোনো একজনকে বার্ধক্যে উপনীত অবস্থায় পেল তবুও সে (তাদের খেদমত করে) জান্নাতের পথ সুগম করতে পারল না, (মুসলিম : ২৫৫১)।
চার. পিতা-মাতা অক্ষম হলে তাদের খরচ দেওয়া। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, ‘আমার সম্পদ আছে, সন্তান আছে। আমার পিতাও আছেন। আমার পিতা আমার সম্পদের মুখাপেক্ষী।’ (এখন আমার করণীয় কি?) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি ও তোমার সম্পদ তোমার পিতার। আরও বললেন, তোমাদের সন্তানাদি তোমাদের সর্বোত্তম উপার্জন। সুতরাং, তোমরা তাদের সম্পদ ভোগ করতে পার’, (ইবনে মাজাহ : ১৮৭০)।
এসব হচ্ছে পিতামাতা জীবিত থাকা অবস্থায় দায়িত্ব। মারা গেলেও কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেগুলো হলো তাদের জন্য দোয়া করা, কবর জিয়ারত করা, তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সদাচরণ করা। হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একবার বনু সালামার এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করল, আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও কি তাদের সঙ্গে সদাচরণের কিছু বাকি থাকে? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তাদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করবে, মৃত্যুর পর তাদের কোনো বৈধ অসিয়ত থাকলে সেটা পূরণ করবে, তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে আর তাদের বন্ধু-বান্ধবকে সম্মান করবে’। (আবু দাউদ : ৫১৪২, ইবনে মাজাহ : ৩৬৬৪)।
অন্য হাদিসে আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো ব্যক্তির সর্বোত্তম নেক কাজ হলো, পিতার অবর্তমানে তার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সদাচরণ করা। (মুসলিম : ২৫৫২)।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের পিতা-মাতার অবাধ্যতা ও অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থেকে তাদের খুশি করে চলার তৌফিক দান করুন।
অনুবাদক, প্রাবন্ধিক।