(ক) শরিয়ত অনুমোদিত বৈধ ও হালাল ব্যবসা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যার অন্যতম হালাল ব্যবসায় হচ্ছে ‘মুদারাবা’। এই ‘মুদারাবা’ ব্যবসায় এর একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে, পুঁজি বা মূলধন (পুরো বা আংশিক) এক পক্ষের বা একজনের এবং শ্রম বা ব্যবসায় পরিচালনার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব অপরপক্ষের, অন্যজনের। এ অবস্থায়, ব্যবসায়ের লাভ কার কত অংশ হবে তা প্রাক-চুক্তি মোতাবেক উভয়পক্ষ নির্ধারণ করে নেবেন। উদাহরণত, পুঁজি বিনিয়োগকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ অংশ এবং শ্রম ও জনবল নিয়োগকারী ব্যক্তি/পক্ষ/প্রতিষ্ঠান বাকি অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ অংশ ইত্যাদি। এভাবে লভ্যাংশ বা মুনাফার কমবেশি একটা হার উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে ধার্য করা জরুরি। নতুবা এই মুদারাবা ব্যবসায়ই জায়েজ হবে না।
এ থেকে বোঝা গেল যে, ‘ধার্য’ বা ‘নির্ধারণ’ মানেই শরিয়তে সর্বক্ষেত্রে হারাম বা নিষিদ্ধ নয়। বরং ক্ষেত্রবিশেষে পূর্ব নির্ধারণ চুক্তি বা একটা হার ধার্যকরণ বা নির্দিষ্টকরণ ব্যতীত ব্যবসায়/বিনিয়োগটিই অবৈধ হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, নির্ধারণ বা নির্দিষ্টকরণ বলতে এমন চুক্তি উদাহরণত, আমাকে মাসিক ৫০০/- টাকা বা ৫,০০০/- টাকা (অঙ্ক নির্ধারণ) দিতে হবেÑ এমন প্রকৃতির নির্ধারণ বা নির্দিষ্টকরণ জায়েজ হয় না।
(খ) সুদভিত্তিক ব্যবসায়-বিনিয়োগ শরিয়তের নির্দেশ মোতাবেক হারাম। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবে সুদ কাকে বলে? বা সুদের সংজ্ঞা, পরিস্থিতি, শর্তাবলী ও সুদ প্রমাণিত হওয়ার বিভিন্ন কারণ হয়ে থাকে। যার অন্যতম কারণ হচ্ছে নির্দিষ্টকরণ বা ধার্যকরণ, কিন্তু এটি সুদ প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র কারণ নয়।
(গ) শরিয়া আইনের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা মোতাবেক মূল ব্যবসায় বিনিয়োগ বা তার প্রক্রিয়া পদ্ধতি যদি সুদভিত্তিক বা সুদি কার্যক্রম অনুযায়ী পরিচালিত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে মুনাফা/লভ্যাংশ নির্ধারিত হোক বা অনির্ধারিত/অনির্দিষ্ট হলেও, তা হারাম ও নিষিদ্ধ হিসেবে গণ্য।
(ঘ) বাংলাদেশে পরিচালিত ও প্রচলিত ইসলামি ব্যাংকগুলোর শরিয়াভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত কার্যক্রম/প্রক্রিয়া-পদ্ধতি/ নীতিমালাবিষয়ক কিছু কাগজপত্র এর আগে ব্যক্তিগতভাবে আমিও দেখেছি এবং অনুসন্ধান করেছি। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট কর্মরতদের সঙ্গে মৌখিকভাবেও আলোচনা করেছি। তা থেকে আমার কাছে অনুমতি হয়েছে, তারা যথাসাধ্য শরিয়া মোতাবেক মূল ব্যবসায়-বাণিজ্য পরিচালনায় সচেষ্ট। তবে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় যেমন : (১) আগে থেকে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুদভিত্তিক হওয়ায় তার অধীনে সংগত ও বাস্তব কারণে এসব ইসলামি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকেও ক্ষেত্রেবিশেষে সুদের মুখোমুখি হতে হয়। (২) রাষ্ট্র অনুমোদিত যথাযথ কর্তৃপক্ষের বা নির্ভরযোগ্য ‘শরিয়া বোর্ড’ অনুমোদিত পূর্ণাঙ্গ ‘শরিয়া অ্যাক্ট’ এর অনুপস্থিতি। (৩) এসব ব্যাংকের কারও কারও বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্তায় অর্থায়নের অভিযোগ; যদিও তা আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত কি-না জানা যায়নি। (৪) এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের নিজস্ব শরিয়া বোর্ডের সিদ্ধান্তগুলোও যথাযথভাবে বাস্তবায়নে অনীহা প্রদর্শনের অভিযোগ (যদিও তা বাস্তব কি-না আমার জানা নেই) ইত্যাদি। এসব কারণে সংশ্লিষ্টরা শতভাগ ইসলামি শরিয়া মোতাবেক তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় সফল হয়েছেন মর্মে না-ও বলা যেতে পারে।
কিন্তু আলোচিত এসব প্রসঙ্গ বা কারণের দায়-দায়িত্ব যেমন আমানত/বিনিয়োগ সোপর্দ বা গচ্ছিত রাখা সাধারণ মুসলমান/ জনগণ/ গ্রাহক/ ভোক্তাদের ওপর বর্তায় না; তেমনি ১০০ শতাংশ সফল হতে না পারাতে, কাউকে সুদি ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে বলাও জায়েজ নয়।
(ঙ) যে-কারণে একজন মুসলামন হিসেবে সুদের সংশ্লিষ্টতা থেকে যথাসাধ্য মুক্ত থাকার লক্ষ্যে অপরাপর সুদি ব্যাংকের তুলনায় ইসলামি ব্যাংকগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। তার কারণ, শরিয়া আইনের মূলনীতিতে বলা আছে যখন তুমি দুটি সমস্যায় বা উভয় সংকটের মুখোমুখি হও তখন যেটি বা যে দিকটি তুলনামূলক সহজ বা উত্তম সেটি গ্রহণ করো।’ এর আলোকে প্রচলিত ইসলামি ব্যাকগুলোকেই আমানত সংরক্ষণের, ব্যবসায়-বিনোয়োগ প্রয়োজনে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
(চ) ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভের পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষ লোকসানের ঝুঁকিও একটি বাস্তবতা। তবে ইসলামি ব্যাংকগুলোর কর্তৃপক্ষ যেভাবে বাস্তব অনুসন্ধান ও পরিস্থিতি বুঝে বিনিয়োগ করে থাকেন, সে হিসাবে লোকসানের বাস্তবতা অনেকটা ব্যতিক্রমই হয়ে থাকে। তারপরও ২-১টি ক্ষেত্রে লোকসান গুনলেও তা ব্যাপক ও সার্বিক পরিসংখ্যানের তুলানায় অনুল্লেখযোগ্য। যে কারণে বার্ষিক প্রদত্ত লভ্যাংশ নির্ধারণ ও ঘোষণার ক্ষেত্রে হেরফের বা পার্থক্য তেমন বড় পরিসরে হয় না। সে হিসেবে পেছনের বা বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যান সামনে রেখে সংশ্লিষ্টরা বিনিয়োগকারীদের জন্য উদাহরণত ১৩ শতাংশ ১৫ শতাংশ ২০ শতাংশ ২৫ শতাংশ বা কমবেশি নির্দিষ্ট মুনাফা শুনিয়ে থাকেন বা প্রস্তাব করেন। এমন প্রকৃতির নির্দিষ্টকরণ বা ইজমালিভাবে হার নির্ধারণ (অঙ্ক নয়) ‘সুদ সংশ্লিষ্ট’ হারাম বা অবৈধের মধ্যে পড়ে না।
(ছ) উল্লেখ্য, শরিয়া আইনে যে-কোনো বিষয়-ব্যাপারে ‘মৌল বিষয়’ বা ‘মৌলিক বিবেচ্য’ এর একটা দিক হয়ে থাকে; আবার ‘প্রাসঙ্গিক বিষয়’ বা ‘প্রাসঙ্গিক বিবেচ্য’ আরেকটি দিক তথা ভিন্ন বিষয় হয়ে থাকে। সে হিসাবে একজন সাধারণ মুসলমান বা জনগণের কাছে মৌলিকভাবে দেখার বিষয় হবে, তাদের বিনিয়োগ করা বা গচ্ছিত রাখা অর্থ হালাল প্রক্রিয়া-পদ্ধতি মোতাবেক ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হয়ে লাভ/মুনাফা অর্জিত হচ্ছে কি-না? তাদের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা এতটুকুই। বাকি, উপরে আলোচিত নেতিবাচক ‘প্রসঙ্গ’/‘কারণ’ তথা ‘প্রাসঙ্গিক সমস্যাগুলোর সঙ্গে যারা জড়িত বা সম্পৃক্ত, সেগুলোর দায়-দায়িত্ব ও জবাবদেহিতা তাদেরই ওপর বর্তাবে; সাধারণ জনগণ বা ভোক্তা বা গ্রাহক বিনিয়োগকারীর ওপর তা বর্তাবে না।
সুতরাং উপরিউক্ত বিস্তারিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মৌল ও মুখ্য বিবেচনায় যেহেতু ইসলামি ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়-বিনিয়োগ বৈধ ও তার অর্জিত লভ্যাংশ হালাল। তাই, আপনারা যাচাই-বাছাই করে, যাদের ‘শরিয়া বোর্ড’ রয়েছে তেমন যে কোনো একটি ইসলামি ব্যাংকের ‘মুদারাবা’/‘মুশারাকা’/‘বাইয়ে-মুয়াজ্জল/‘মুরাবাহা’ ইত্যাদিতে শরিক বা বিনিয়োগ করতে পারেন এবং তার বিনিয়োগের লাভ-মুনাফাও হালাল ও বৈধ বলে গণ্য হবে।
লেখক : গ্রান্ড মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
তথ্যসূত্র :
১. রাদ্দুল মুহতার/শামী : খ-৮, পৃ: ৩৭৩-৩৭৬; মাকতাবা আশরাফিয়া, দেওবন্দ, ভারত।
২. কাওয়াইদুল ফিকহি : পৃ: ৫২(১), ৫৬(১৯), ৬২(৫১),১২১(৩১৯); আশরাফিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত।
৩. বাদায়েউছ ছানায়ে : খ-৫, পৃ. ১০৮-১০৯; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত।
৪. আল ফিকহুল ইসলামি ফী ছাওবিহিল জাদীদ: খ-৫, পৃ-৬৭-৭৩; দারুল কলম, দামেস্ক, ২০০১ সংস্করণ।
৫. আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ির : পৃ-৩১, ৯০; মাকতাবা নাযারে মোস্তফা, রিয়াদ।
৬. আল-বাহরুর বায়িক : খ-৭, পৃ ৪৪৮-৪৪৯; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত।
৭. ফিকহি মাকালাত : খ-১, পৃ-২৬৯-৩০১; যমযম বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত।
৮. জাদিফ ফিকহি মাবাহিছ : খ-৩, পৃ-৪৯৯-৬৩৯; ইদারাতুল কোরআন ওয়াল উলুমিল ইসলামিয়া, ৪৩৭-ডি গার্ডেন ইস্ট, করাচি।