(ক) ‘বাই মুয়াজ্জাল’ তথা বাকিতে বিক্রয় বা ‘বাই’ ‘ইলা আজাল’ বা ‘বাই বিছ্ছামানিল-আজাল’ বা ‘বাই আন্নাছীআ’ সবগুলো একই এবং সবগুলোর মূলকথা বাকিতে বিক্রয়। আর বাকিতে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে নগদ বিক্রির সমমূল্যে বিক্রয়- যেমন জায়েজ ও উত্তম তেমনি একটু বেশি মূল্যে বিক্রয়ের বৈধতাও শরিয়া আইনে রয়েছে। এই বৈধতার মূলকথা তৎকালিন ‘উরফ’ ও প্রচলন; যা প্রিয়নবী (সা.) নেতিবাচক কিছু ব্যক্ত করে নিষেধ না করে, বরং বৈধ রেখেছেন। এক্ষেত্রে মৌলিক আইনি বিবেচ্য হচ্ছে ‘উরফ ও তা’আমুল’। যৌক্তিক মানদণ্ড বা অপরাপর নস্ তথা সময়ের বিবেচনায় বেশি লাভ ধার্য-অবৈধ হওয়ার বক্তব্য, এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ, এই ‘উরফ’ এর বৈধতা সম্পর্কে পৃথক নস/হাদিস রয়েছে। আর শরিয়া আইনের মূলনীতি রয়েছে- ‘এক ‘নস’-এর কারণে অন্য ‘নস’ বাতিল হয় না’ (উসূলে ফিকাহ : মুফতি আমিমুল ইহসান (রহ.)।
(খ) এ ছাড়া, কোনো আইন-বিধানের বৈধতা-অবৈধতার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় থাকে মৌলিকভাবে ধর্তব্য আর কিছু ব্যাপার থাকে গৌণ বা প্রাসঙ্গিক হিসাবে বিবেচ্য। ধর্তব্য বিষয়টি মূখ্য ও মৌলিক আর বিবেচ্য বিষয়টি গৌণ ও প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে। সে হিসাবে ‘বাই মুয়াজ্জাল’-এর বৈধতা প্রমাণিত ‘উরফ’ ও সুনির্দিষ্ট ‘নস’ এর বিধান মতে; অধিক সময়ের বিনিময় গ্রহণের যৌক্তিক বিবেচনায় তার বৈধতা প্রমাণিত হয়নি। যেকারণে শরিয়া আইনের মূলনীতিতে অন্যতম অনুসৃত মূলনীতি হচ্ছে।
তবে অপরাপর ‘নস’ দ্বারা যেহেতু পৃথকভাবে সময়ের বিবেচনায় পূর্বনির্ধারিত মূল্যের বৃদ্ধি বা পুনঃবৃদ্ধি জায়েজ (যা প্রথম দফা ধার্যের ক্ষেত্রে জায়েজ হয়ে থাকে) নয়। তাই গ্রাহক/ক্রেতা মূল্য বা বকেয়া পরিশোধে খেলাফি হোক বা বিলম্ব করুক পূর্ব-নির্ধারিত মূল্যবৃদ্ধি করা বা দাবি করার আইনত কোনো সুযোগ নেই। অবশ্য এক্ষেত্রে জরিমানার প্রসঙ্গ ভিন্ন। তা যদি অপর কোনো বিধি বা নস মোতাবেক অথবা পারস্পরিক সমঝোতা ও প্রাকচুক্তি মোতাবেক হয়, সেটা ভিন্ন হিসাব।
সিদ্ধান্ত :
১। ‘বাই মুয়াজ্জাল’-এর বৈধতা যেহেতু ‘নস’-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তাই বিধি মোতাবেক তার অনুশীলন বা প্রয়োগ ইসলামি ব্যাংক বা যারাই করুক, তা জায়েজ ও বৈধই গণ্য হবে।
২। প্রথম দফা বিক্রয়ের সময় বাজার মূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশি মূল্য ধার্য করে বিক্রয় করা জায়েজ। তবে পরবর্তী সময়ে আর তা বৃদ্ধি বা সংযোজন বৈধ নয়।
‘বাই সালাম’ প্রসঙ্গ (পৃ-৭৬)
(ক) ‘বাই সালাম’ বা ‘বাই সালাফ’ অনেকটা ‘বাই মুয়াজ্জাল’ এর বিপরীত বা উল্টো। বাইয়ে মুয়াজ্জালে আগে পণ্য সরবরাহ করা হয় এবং পরে বাকিতে মূল্য পরিশোধ করা হয়। আর ‘বাইয়ে-সালামে আগে মূল্য প্রদান করা হয় এবং পরে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য সরবরাহ করা হয়।
(খ) এ প্রকৃতির ক্রয়-বিক্রয়ও প্রিয়নবী (সা.) ও সাহাবাকিরাম (রা.) এর যুগে এবং তার পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল। মহানবী (সা.) এ প্রচলনকে নিষেধ না করে বরং সমর্থন করেছেন এবং তার পাশাপাশি কিছু নির্দেশনাও দিয়ে গেছেন। যেমনটি হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত (বোখারি ও মুসলিম) হাদিসটিতে বিদ্যমান।
তাছাড়া, সুরা বাকারার ২৭৫নং আয়াতের ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপক বৈধতার আওতায় এ পদ্ধতিটি অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছাড়াও সুরা বাকারার ২৮২নং আয়াতের তফসির মোতাবেক সরাসরি এ পদ্ধতিটির কথাই বর্ণিত হয়েছে (ইবনে কাসির : ১ম খ. ৪৯৬ পৃ)। সুতরাং আলোচ্য বাইয়ে সালাম কেন্দ্রিক লেনদেনও নিঃসন্দেহে বৈধ ও জায়েজ।
(গ) লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এ ক্রয়-বিক্রয়ের সময় বিক্রেতার কাছে পণ্য-ফসলটি অনুপস্থিত এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বাস্তবেও নেই (৬ মাস/ ১ বছর পর ফল-ফসল উৎপন্ন হবে, তার পর সরবরাহ করা হবে) তবুও ক্রয়-বিক্রয়ের এ প্রক্রিয়া বৈধ। অথচ অন্য নস/হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যা তোমার কাছে নেই, তা বিক্রি করবে না।’
সুতরাং বোঝা গেল, যেসব ক্রয়-বিক্রয় পৃথক পৃথক নস/দলিল দ্বারা প্রমাণিত তা একটির দ্বারা আরেকটিকে কিয়াস/ইজতিহাদ এর মাধ্যমে অবৈধ বলা যাবে না; যদিও তা বাহ্যিকভাবে অযৌক্তিক মনে হোক। এ কারণেই ফিকহের মূলনীতিতে বলা হয়েছে : (কোরআন-সুন্নাহর দলিল/প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত একটি বিষয়-বিধানকে আরেকটি বিধান-বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করা চলবে না) অর্থাৎ প্রত্যেকটি স্ব স্ব স্থানে যথার্থ ও বহাল থাকবে।
আরেকটি আইন ও গবেষণাবিষয়ক মূলনীতি হচ্ছে : (কোনো বিষয়-বিধান সম্পর্কে দলিল/নস পেশ করার অর্থ এটা নয় যে, তাতে আর কোনো দলিলের প্রয়োজন নেই, শুধু এই নস্টিই এক্ষেত্রে ‘খাস’ তথা শেষ কথা) অর্থাৎ ক্ষেত্র বিশেষে একই দলিল একাধিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে, তবে তা সর্বত্র নয়।
সিদ্ধান্ত : মোট কথা ইসলামি ব্যাংকের অনুসৃত ‘বাই সালাম’ প্রক্রিয়াটিও কোরআন-সুন্নাহসম্মত বৈধ ব্যবসায়-বাণিজ্যের অন্তর্ভুক্ত (শামী, আলমগীরী ও বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ইত্যাদি দ্রষ্টব্য)।
লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ