ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৮ আশ্বিন ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দ্বীনের পথে আসার গল্প

দ্বীনের পথে আসার গল্প

২০১৭ সালের কথা। আমি এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তখন থেকে আমার দ্বীনের পথে আসার যাত্রা শুরু। প্রথম দিকে শুধু উপলব্ধি করতে থাকি, আমি যেভাবে চলি, আমার পরিবার যেভাবে চলে, এটা ঠিক নয়। আল্লাহর সব আদেশ মানা উচিত, নিজেকে শুধরানো উচিত। ওই সময়টা আমি জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছি। অনেক রকম গোনাহ থেকে যখন সরে আসতে থাকি, তখনই শুরু হয় আমার ঈমানি পরীক্ষা। ব্যক্তিগত অনেক সমস্যার কারণে আরও এমন সব জটিলতা থাকায়, দিনদিন মানসিক চাপে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

ইন্টার পরীক্ষার সময় কিছু স্বপ্ন দেখি। তখন বুঝতে পারিনি, আমার রব আমায় তার পথে চলার ইশারা দিচ্ছেন। এখন এ সময় এসে বুঝতে পারি, স্বপ্নগুলো আমার জন্য কত বড় নেয়ামত ছিল। স্বপ্নে দেখি, আল্লাহ দুনিয়াতে একজন জাহান্নামিকে পাঠিয়েছেন। তার সারা শরীর আগুনে পুড়ে ছারখার। কুঁকড়ে গেছে একদম। শুধু ছাই আর কয়লার দেহ। চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। কান্না করছে অবিরত। আমি ভয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি। ঘেমে যাই অস্থিরতায়। ওজু করে সালাতে দাঁড়াই।

কিছুদিন স্তব্ধ হয়ে পড়ি। এরপর আগের মতো স্বাভাবিক চলাফেরা করি। কিছুদিন পর আবার স্বপ্নে দেখি, আমি জান্নাতুল বাকিতে দাঁড়িয়ে আছি। ভরা জ্যোৎস্না রাত। কোনো এক জিহাদে অনেক সাহাবি শহীদ হয়েছেন। তাদের জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থেকে তার তদারকি করছেন রাসুল (সা.) ও খাদিজা (রা.)। এটুকু দেখার পরই শরীর ঘেমে উঠল। ভয়ে ঘুম ভেঙে গেল।

এ স্বপ্নগুলোর পর থেকে নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করি। গোনাহ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। এতে আসে নানান বিপত্তি। ব্যক্তিগতভাবে খুব সমস্যায় পড়ি। ইন্টার পরীক্ষাগুলোও কোনো রকম শেষ করি। কিছু না পড়েই পরীক্ষার হলে গিয়ে বসি। সারা রাস্তা বাসে কান্না করি। পরীক্ষার পর এলো ভার্সিটি অ্যাডমিশন কোচিং। কিন্তু আমার মানসিক অবস্থা বেহাল। আমি দুনিয়া নিয়ে স্থায়ী কিছু ভাবতে পারি না। মনে হয়, কী হবে এসব পড়াশোনা করে! বারবার গোনাহের কথা মনে পড়ে। কোচিংয়ে কোনো রকম লেকচার শুনি। বাসায় ফিরে পড়ায় মন বসে না।

গোনাহের জন্য মাফ চাই আল্লাহর কাছে। কান্না করি রোজ। রাত জেগে জেগে নামাজ পড়ি। অনেকদিন দু’রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তে পড়তে ফজর ঘনিয়েছি। সেজদায় কান্না করি। জায়নামাজে বসে কান্না করি। আল্লাহকে খুব বেশি আপন মনে হয়। মন থেকে আলাদা একটা শক্তি পাই। এক রাতে নামাজ পড়ে শুয়ে পড়লাম। এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। নিজেকে বদলাতে আরম্ভ করি। ফেইসবুকের সব ছেলেবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। মোবাইল নম্বর বদলে ফেলি।

নতুন একটা আইডি খুলি। কোনো বন্ধু যুক্ত করি না তাতে। শুধু কয়েকটা ইসলামি পেজে লাইক দিয়ে রাখি। একদিন একটি মেসেজ এলো। আমি কথা বলা আরম্ভ করি। অচেনা সেই আইডির লোকটির কাছে হতাশার কথা খুলে বলি। আমার গোনাহের গল্প গড়গড় করে বলতে থাকি। অথচ তখনও জানি না, আইডিটা কার! কেন তাকে সব বলি, তাও জানা নেই। একটা সময় আমার হতাশা দেখে সে বলল, ‘আপনার গোনাহ কি আপনার রবের করুণার থেকেও বেশি?’ শুধু আমার আল্লাহ জানেন আর আমি জানি, আমি কতটা স্বস্তি অনুভব করেছিলাম সেই কথাটায়। সে আমায় দোয়া পড়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলল। আমিও তাই করলাম। পরদিন সকালবেলা আইডিতে ঢুকি। দেখি, সে আমায় ব্লক করে দিয়েছে। ভাবলাম, আমার সঙ্গে এটা কি হলো! আমি আগের রাতে তার আইডির নামও ভালোভাবে খেয়াল করিনি। শুধু পরিচয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর এক বান্দা।’

দিন দিন আমার বদল আরম্ভ হয়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় জীবনযুদ্ধ। মাহরাম-গাইরে মাহরাম মেনে চলতাম। কিন্তু পড়লাম বিপাকে। পরিবার থেকেই বেশি কথা শুনতে হতো। চুল ঢেকে কারও সামনে গেলে সবাই বিরক্ত হয়ে ঘোমটা খুলে দিত। আমার কান্না পেত খুব। কিছু বলতে পারতাম না কাউকে। জঙ্গি, ভূত আরও অনেক কিছু উপাধি পেলাম। সবার কথা ছিল, আত্মীয়দের মধ্যে আবার পর্দা কীসের! আমি আগ থেকেই প্রচুর কেনাকাটা করি। কলেজে প্রতিটি উপলক্ষে আলাদা পোশাক কিনতাম। পার্লারে যেতাম। তখন পরিবারের কেউ নিষেধ করত না। কিন্তু যখন ঢোলা বোরকা, কালো ওড়না, নেকাব কিনতে টাকা চাইলাম, বাসা থেকে টাকা দিল না। আমার কাছে টাকাও ছিল না। কম দামি কিছু কিনে পর্দা শুরু করার ব্যবস্থাও হলো না।

আমিও নাছোড়বান্দা। কয়েক মাস ধরে টাকা জমালাম। আমার প্রথম পর্দার সঙ্গী হলো ৩০০ টাকার কালো ওড়না, একটা নেকাব আর একজোড়া হাত-পা মোজা। এগুলো নিয়েও অনেক কথা শুনতে হলো। তবুও মনে হলো, আমার দ্বীনের পথ ধীরে ধীরে সহজ হচ্ছে।

সে সময়টাতে দ্বীনি বোন হিসেবে পরিচয় হয় আমার ননদের সঙ্গে। তার কাছ থেকে প্রচুর মানসিক সাপোর্ট পেলাম। আমার একটা অবলম্বন খুব প্রয়োজন ছিল। সেই যে পথচলা শুরু, এখনও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। প্রতিটি পদে পদে ঠকে ঠকে শিখেছি। আমার বিয়েটাও আমার রবের পক্ষ থেকে আমার জন্য পুরস্কার। শাশুড়ি, ননদ ও বাসার সবার কাছ থেকে খুব সাপোর্ট পেয়েছি। আর বিয়ের পর থেকে আমার পরিবারও এখন আর কিছু বলে না।

কোনো ছেলের কাছে দ্বীনের ব্যাপারে সাহায্য চাওয়া অপছন্দ করি। আমার জীবনে এর তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। দ্বীনের পথে আসার জন্য ফ্রি মিক্সিং বাদ দেওয়া উচিত; সেটা কোনো পাঞ্জাবি-টুপিপড়–য়া হলেও। এটা আসলে নেক সুরতে শয়তানের ধোঁকা। কেউই নিজের নফস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে কথা বলা মুখের জেনা। তার কথা চিন্তা করা মনের জেনা। আমরা ভাবি, আমি তো তার থেকে ইসলামের বিষয়ে জানতে চাচ্ছি, পাপ হবে কেন? পাপ না হলো, একটা সময় নিশ্চিত ফেতনায় পড়তে হয়। আল্লাহ সবাইকে সঠিক পথের দিশা দান করুন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত