ঢাকা শুক্রবার, ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

ওলামায়ে কেরাম ও সীমান্তরক্ষীদের অভিনন্দন

ওলামায়ে কেরাম ও সীমান্তরক্ষীদের অভিনন্দন

ইসলামি শরিয়ত মানুষের ইহ-পরকালের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য করে। মানব কল্যাণের মাধ্যমে জাতি ও সমাজকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করা শরিয়তের অন্যতম উদ্দেশ্য। দুটি শ্রেণি এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। তারা জাতির মুক্তিসেনা ও নিরাপত্তা বিধানকারী ওলামায়ে কেরাম ও প্রতিরক্ষা বাহিনী।

ওলামায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য

ওলামায়ে কেরাম নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধি ও কর্মের সংশোধন করে থাকেন। সমগ্র পৃথিবীর কল্যাণ সাধন করেন। তারা জাতির ইমাম ও পথপ্রদর্শক। দ্বীন ও ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী। মুখলিস, মুত্তাকি, হক্কানি ওলামায়ে কেরামই এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। যারা অনন্য বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ও ইজতিহাদের যোগ্যতার অধিকারী। শরিয়তের মূলনীতি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত। যেকোনো বিষয়কে শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিচার-বিবেচনায় পারঙ্গম। মানুষের মাঝে তাদের অস্তিত্বই শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার কারণ। কিন্তু কিছু মানুষ তাদের মর্যাদা সম্পর্কে অন্ধ। তারা শিকার হন মানুষের তিরস্কার, কটাক্ষ ও নিন্দার। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেন, ‘কতই না সুন্দর তাদের অবদান! আর কতই না নিকৃষ্ট তার প্রতিদান।’

সবচেয়ে বেশি শোকাহত কীসে হওয়া উচিত?

হক্কানি ওলামায়ে কেরামের কারও বিয়োগই জাতির সবচেয়ে বড় শোকের বিষয়। এটিই সবচেয়ে দুঃখের, বেদনার। তারা রাসুল (সা.)-এর ওয়ারিস ও নবীদের প্রতিনিধি। নবুয়তের উত্তরাধিকারের রক্ষক। মানুষের জন্য তারা প্রদীপ্ত সূর্য, উজ্জ্বল তারকা, আঁধারের বাতিঘর, পথপ্রদর্শনের আলোকবর্তিকা। তাদের মাধ্যমেই দ্বীনের হেফাজত হয়; উম্মাহর মিনার সুউচ্চ হয়। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘ওলামায়ে কেরাম তারকার মতো। তারকার মাধ্যমেই মানুষ বিস্তৃত সমুদ্র ও মরুভূমিতে পথ পেয়ে থাকে। তারকা নিষ্প্রভ হয়ে গেলে পথপ্রদর্শকরাও পথ হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়। (মুসনাদে আহমদ)। ওলামায়ে কেরামের বিয়োগের ক্ষতিটা পূর্ণরূপে অনুভব হয় রাসুল (সা.)-এর আরেকটি হাদিস থেকে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা মানুষের থেকে একসঙ্গে ইলম তুলে নেবেন না। তিনি ইলম তুলে নেবেন ওলামায়ে কেরামকে মৃতুদানের মাধ্যমে। এভাবে যখন আর কোনো আলেম অবশিষ্ট না থাকবে, তখন মানুষ মূর্খদেরকে নেতা বানিয়ে নেবে। তাদের কাছে দ্বীনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে। তারা না জেনে ফতোয়া দেবে। তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে। অন্যদেরও পথভ্রষ্ট করবে। (বোখারি ও মুসলিম)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘ইলম তুলে নেওয়ার আগে তোমরা তা আঁকড়ে ধরো। ইলম তুলে নেওয়া হবে ওলামায়ে কেরামের মৃত্যুর মাধ্যমে।’ আলী (রা.) বলেন, ‘যখন একজন আলেম ইন্তেকাল করেন, ইসলামে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তার যথাযথ প্রতিনিধি ছাড়া কেউ সে শূন্যতা পূরণ করতে পারে না।’ (সুনানে বায়হাকি)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কি দেখে না, আমি ভূমিকে চারদিক থেকে গুটিয়ে আনি?’ (সুরা রাদ : ৪১)। মুফাসসিররা এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘জমিনের ওলামায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীনের মৃত্যুর মাধ্যমেই মূলত জমিনকে গুটিয়ে আনবেন আল্লাহতায়ালা।’

সাঈদ ইবনে জুবায়েরকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মানুষের ধ্বংস ও কেয়ামতের আলামত কী?’ তিনি বললেন, ‘ওলামায়ে কেরামের মৃত্যুবরণ।’ জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-এর ইন্তেকালের পর আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, ‘জ্ঞান কীভাবে বিদায় নেবে, এটা যে দেখতে চায়, সে দেখে নিক; এভাবেই জ্ঞানের বিদায় হবে।’ কবি বলেন, ‘যখন কোনো জ্ঞানী ও বুজুর্গের ইন্তেকাল হয়, তখন ইসলামে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তাহাজ্জুদগোজার, ইবাদতকারী ব্যক্তির মৃত্যু বড় বিপদ ও মসিবত। আল্লাহওয়ালা বুজুর্গের বিয়োগ বিশাল ক্ষত সৃষ্টি করে। তার অস্তিত্ব ইসলামের জন্য ঔজ্জ্বল্য।’ এ যুগের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হলো, ওলামায়ে কেরামের সংখ্যা কমে আসা; জ্ঞানের সুউচ্চ চূড়াগুলো ধসে পড়া।

ওলামায়ে কেরামের ব্যাপারে উম্মাহর দায়িত্ব

মুসলমানদের দায়িত্ব হলো, ওলামায়ে কেরামকে সম্মান করা, তাদের থেকে উপকৃত হওয়া, তাদের প্রশংসা করা। যারা ওলামায়ে কেরামের নিন্দা করে, তারা পথভ্রষ্ট। ওলামায়ে কেরামের জন্য দোয়া করতে হবে। জীবিত আলেমদের জন্য যেমন, তেমন মৃত আলেমদের জন্যও।

নিরাপত্তাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষীদের প্রতি সালাম

উম্মাহর মুক্তিসেনাদের দ্বিতীয় দলটি হলো, দেশের নিরাপত্তা রক্ষীরা। তাদের আবার দুটি দল একদল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখেন; অপর দল সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত থাকেন। তারা একই মূল থেকে উদ্গত জোড় বৃক্ষ। তাদের শেকড় জমিনে, শাখা আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের ছাড়া আমরা সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকতে পারি না। যতদিন বেঁচে আছি, তাদের থেকে কেউই অমুখাপেক্ষী নই। আন্তরিক অভিনন্দন আমাদের নিরাপত্তাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষীদের প্রতি।

সীমান্ত পাহারার ফজিলত

রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকেও তাদের জন্য রয়েছে অনেক বড় সুসংবাদ। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘দুটি চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে নাÑ এক. আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী চোখ, দুই. সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত চোখ। (তিরমিজি)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় একদিন সীমান্ত পাহারা দেওয়া দুনিয়া ও তার মাঝে যা আছে, তার সবকিছু থেকে উত্তম। জান্নাতে এক চাবুক পরিমাণ জায়গা দুনিয়া ও তার মাঝে যা আছে, তার সবকিছুর চেয়ে উত্তম। আল্লাহর রাস্তায় এক সকাল ও এক সন্ধ্যা কাটানো দুনিয়া ও এর মাঝে যা আছে, তার সবকিছুর চেয়ে উত্তম।’ (বোখারি)। রাসুল (সা.) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে আরও বর্ণিত, ‘এক দিন এক রাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া এক মাস রোজা রাখা ও রাতে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম। সীমান্তরক্ষী মৃত্যুবরণ করলে তার অর্জিত জ্ঞানের সওয়াব জারি থাকবে এবং সে ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (মুসলিম)।

মৃত ব্যক্তির সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে মুসলিম ভূখ-ের সীমান্ত প্রহরীর আমল জারি থাকে। আল্লাহতায়ালা তার আমলকে কেয়ামতে বর্ধিত করে দেবেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তার সীমান্ত প্রহরী ছাড়া সব মৃত ব্যক্তিরই আমল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার আমলকে আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন বর্ধিত করে দেবেন। সে কবরের পরীক্ষা থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (তিরমিজি)।

ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘এ হাদিসদ্বয় প্রমাণ করে, সীমান্ত পাহারা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল। মৃত্যুর পরেও তার সওয়াব জারি থাকে। এর কারণ হলো, কোনো নেক আমলই শত্রু থেকে নিরাপদ থাকা ছাড়া সুন্দরভাবে করা সম্ভব হয় নয়। তারা দ্বীনের হেফাজত করেন। ইসলামের নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করেন। তাদের মাধ্যমে ইসলাম টিকে থাকে। তাই তাদের আমলের সওয়াবও অব্যাহত থাকে।’ কবি বলেন, ‘বিশুদ্ধ হাদিসে সীমন্তরক্ষীদের ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। তারা আমাদের সৈনিক। তারা কাপুরুষতা করেননি। যখন তারা সীমান্তে শত্রুদের দেখেছেন, তারা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।’

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় সীমান্ত পাহারা দেওয়া হারামাইন শরিফাইনে এতেকাফের চেয়েও অধিক ফজিলতপূর্ণ।’ আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) ফজল ইবনে মুবারক (রহ.)-কে লেখেন, আমাদের কাছে বিশুদ্ধ সূত্রে রাসুল (সা.)-এর এ বক্তব্য এসেছে, ‘জাহান্নামের আগুন আর ওই নাক, যাতে আল্লাহর রাস্তার ধূলা ঢুকেছে; তা একত্রিত হবে না। এই যে আল্লার কিতাব, যা আমাদের সামনে কথা বলছে, শহীদরা মৃত নয়। কোরআন মিথ্যা বলে না।’

১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৩ হিজরি মোতাবেক ২১ জানুয়ারি ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত