অন্যের দোষচর্চা, গিবত, অপবাদ বা কুৎসা রটানো গর্হিত কাজ। তবে মানুষের কল্যাণ বিবেচনায় কিছু ক্ষেত্রে তা বৈধ। যেমনÑ
অত্যাচার বা নিপীড়নের অভিযোগ
অত্যাচার বা নিপীড়নের ব্যাপারে অভিযোগ করা গিবত নয়। নিপীড়িত ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রপ্রধান, বিচারক বা এমন কারও কাছে তার ওপর নির্যাতনকারীর ব্যাপারে অভিযোগ করে, যে নির্যাতনকারীর ওপর কর্তৃত্ব বা শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখে, তাহলে এ অভিযোগ গিবত হবে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহতায়ালা কোনো মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। তবে কারও প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে সে কথা ভিন্ন।’ (সুরা নিসা : ১৪৮)।
মন্দ দূরীকরণে ও পাপীকে সঠিক পথে ফেরাতে দোষ জানানো
মন্দ দূরীকরণ ও পাপীকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য তার ওপর কর্তৃত্বশীল কাউকে তার মন্দ বিষয়গুলো জানিয়ে সাহায্য চাওয়া গিবত নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে জালেম হোক বা মজলুম।’ আনাস (রা.) বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! মজলুমকে সাহায্য করব, তা তো বুঝলাম। কিন্তু জালেমকে কেন?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি তার হাত ধরে তাকে বিরত রাখবে। (অর্থাৎ তাকে জুলুম করতে দেবে না)।’ (বোখারি : ২৪৪৪)। তবে কোনো পাপীর পাপ সম্পর্কে কাউকে অবগত করা তখনই বৈধ, যখন তা কেবল পাপ থেকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে হবে। অন্যথায় এটাও গিবত ও হারাম হবে।
দ্বীনি সমাধান জানতে বিজ্ঞ আলেমের
কাছে অন্যের দোষ বলা
কারও দোষ কোনো মুফতি বা বিজ্ঞ আলেমের কাছে বলে সমাধান জানতে চাওয়া গিবত নয়। যেমনÑ কেউ বলল, ‘আমার পিতা, ভাই বা স্বামী আমার সঙ্গে এই অন্যায় করেছে। এ ব্যাপারে আমি ইসলামের বিধান জানতে চাই।’ আয়েশা (রা.) বলেন, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ রাসুল (সা.)-কে বললেন, ‘আবু সুফিয়ান একজন কৃপণ লোক। আমি তার সম্পদ থেকে (তার অজান্তে) যা কিছু নিই, তা ছাড়া সে আমার ও আমার সন্তানকে পর্যাপ্ত খরচ দেয় না।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি তোমার ও তোমার সন্তানের প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ (তার অজান্তে) নিতে পারবে।’ (বোখারি : ২২১১)। তবে এ ক্ষেত্রেও সতর্কতামূলক কারও নাম উল্লেখ না করা উত্তম। কিন্তু নাম উল্লেখ করলে অসুবিধা নেই।
মন্দ থেকে সতর্ক করা ও মানুষের কল্যাণার্থে কারও দোষ বলা
মুসলমানদেরকে মন্দ থেকে সতর্ক করা এবং তাদের কল্যাণার্থে কারও দোষ বর্ণনা করা গিবত নয়। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে আসার অনুমতি চাইল। রাসুল (সা.) আয়েশা (রা.)-কে বললেন, ‘তাকে আসার অনুমতি দাও। সে তার বংশের অত্যন্ত মন্দ লোক।’ (বোখারি : ৬০৩২)।
দোষযুক্ত হাদিস বর্ণনাকারী ও বিচারকার্যে সাক্ষীর দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা
দোষযুক্ত হাদিস বর্ণনাকারী ও বিচারকার্যে সাক্ষীর দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা গিবত নয়। সর্বসম্মতিক্রমে এটা শুধু বৈধই নয়, ওয়াজিব। আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমার মনে হয় না যে, অমুক অমুক ব্যক্তি আমাদের দ্বীন সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে।’ (বোখারি : ৬০৬৮)।
সামাজিক কাজে পরামর্শ তলবে পরামর্শদাতার সত্যটা বলা
বৈবাহিক সম্পর্ক গড়া, ব্যবসায় অংশীদারি গ্রহণ, আমানত রাখা এবং প্রতিবেশী বানানো ইত্যাদি উদ্দেশ্যে কারও কাছে পরামর্শ চাওয়া হলে পরামর্শদাতা যদি প্রকৃত অবস্থা খুলে বলে, তাহলে তা গিবত হবে না। বরং পরামর্শদাতার জন্য এটা আবশ্যক, তিনি সকল দোষ প্রকাশ করে দেবেন। এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘আমি এক আনসারী নারীকে বিয়ে করার ইচ্ছে করেছি। (এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?)।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘(বিয়ের আগে) তাকে দেখে নাও। কেননা আনসারী নারীদের চোখে কিছু দোষ থাকে।’ (মুসলিম : ১৪২৪)।
দায়িত্বে উদাসীন ব্যক্তির ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো
যদি কোনো দায়িত্বশীল সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে, চাই সেটা তার অযোগ্যতা, পাপাচার, উদাসীনতা কিংবা যেকোনো কারণেই হোক, ওই ব্যক্তির ব্যাপারে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো গিবত নয়। ওমর (রা.) তার শাসনামলে দায়িত্বশীলরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কিনা, এ বিষয়ে তদারকির জন্য একটা বাহিনী নিযুক্ত করেছিলেন। এ ছাড়াও দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের খবর নেওয়ার জন্য তিনি সরাসরি জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলতেন। তাদের অভিযোগ শুনতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)।
প্রকাশ্যে গোনাহে লিপ্ত ও বেদাতির দোষ বলা
প্রকাশ্যে গোনাহে লিপ্ত ও বেদাতির দোষ বর্ণনা করা গিবত নয়। রাসুল বলেন, ‘ফাসেক ও প্রকাশ্যে গোনাহকারী ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করা গিবত নয়।’ (জামিউল উসুল : ৮/৪৫০)। এ হাদিসটির মর্ম অনেকে উল্টোভাবে বোঝে। তারা মনে করে, কবিরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তি অথবা বেদাতে অভ্যস্ত ব্যক্তির গিবত যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই করা যাবে। এতে কোনো গোনাহ হবে না। আসলে বিষয়টা তা নয়। বরং যেই অন্যায় সে প্রকাশ্যে করে, কেবল সেই অন্যায়ের বর্ণনা করাই বৈধ। তাও এ উদ্দেশ্যে, যেন তা অপনোদন সম্ভব হয়। পক্ষান্তরে তার অন্যান্য গোপন দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করা বৈধ নয়। তবে যদি অন্য এমন কোনো কারণও থাকে, যা দ্বারা সাধারণ মুসলমান বিভ্রান্ত হয়, তাহলে তাও ব্যক্ত করা বৈধ হবে।
প্রসিদ্ধ নাম ধরে পরিচয় দেওয়া
প্রসিদ্ধ নাম ধরে পরিচয় দেওয়া গিবত নয়। কোনো ব্যক্তি যখন মন্দ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যায় এবং ওই নাম ছাড়া মানুষ তাকে চিনতে পারে না, তখন সেই প্রসিদ্ধ নাম ধরে তাকে ডাকলে কোনো অসুবিধা নেই। যেমনটা ঘটেছে প্রসিদ্ধ সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.)-এর ক্ষেত্রে। তার প্রকৃত নাম আবদুর রহমান ইবনে সখর। অথচ তিনি পরিচিত ‘আবু হুরায়রা’ নামে। যার অর্থ বিড়ালওয়ালা বা বিড়ালের পিতা। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/৫৭৯)।