ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

ইসরা ও মেরাজ : কিছু চিন্তা কিছু নির্দেশনা

ইসরা ও মেরাজ : কিছু চিন্তা কিছু নির্দেশনা

আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনার গুরুত্ব

পৃথিবীতে আল্লাহর অনেক নিদর্শন রয়েছে, যেগুলো আল্লাহর শক্তির পূর্ণতা প্রমাণ করে। মোমিন বান্দার উচিত, সেসব নিদর্শন নিয়ে চিন্তা-ফিকির ও গবেষণা করা, যাতে সে আল্লাহর পরিপূর্ণ সম্মান ও যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারে। আল্লাহর শক্তি সীমাহীন। মানুষ তাঁর পরিধি অনুমান করতে পারে না। মানুষের শক্তি-সামর্থ্যরে সঙ্গে তাঁর তুলনাও চলে না। ইসরা ও মেরাজের ঘটনা আল্লাহর সেসব নিদর্শনের একটি। এটি মহান রবের কুদরতের বহিঃপ্রকাশ, মানুষের চিন্তা ও কল্পনাতীত এক রহস্যময় ব্যাপার। সূক্ষ্মদর্শী, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান সত্তা বিষয়টিকে বাস্তবায়িত করেছেন। এটি একটি ধ্রুব সত্য ও বাস্তব ঘটনা। ঈমান ও তাওহিদের আকিদার সঙ্গে যুক্ত এমন কিছু বিধান ও হেকমত এর মধ্যে রয়েছে, যে ব্যাপারে মুসলমানদের গুরুত্বারোপ আবশ্যক; এমনকি সর্বদা তার ওপর আমল করাও কর্তব্য।

ইসরা ও মেরাজের হাদিসগুলোর শুদ্ধাশুদ্ধির বিবরণ

ইসরা ও মেরাজ কোরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। রাসুল (সা.)-কে মক্কার মসজিদে হারাম থেকে শামের মসজিদে আকসা পর্যন্ত নৈশভ্রমণ করানো হয়েছে। এরপর আসমানে আরোহণ করানো হয়েছে। প্রতিটি আসমানে আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দারা তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। রাসুল (সা.) এভাবে সাত আসমান অতিক্রম করে সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে মসজিদে হারাম থেকে সেই মসজিদে আকসা পর্যন্ত নৈশভ্রমণ করিয়েছেন; যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছি। (তাকে এ ভ্রমণ করিয়েছি) আমার কিছু নিদর্শন প্রত্যক্ষ করানোর জন্য। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১)।

ইসরা ও মেরাজ সম্পর্কে অনেক সাহাবি হাদিস বর্ণনা করেছেন। সংখ্যায় তারা পঁচিশজন হবেন; যেমনটি হাদিসের হাফেজরা গণনা করে বের করেছেন। তাদের থেকে আবার শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীরা এ-সংক্রান্ত হাদিস শ্রবণ করেছেন। হাদিস ও তাফসিরের কিতাবে সূত্রসহ হাদিসগুলো বর্ণিত হয়েছে। কোথাও সংক্ষেপে, কোথাও বিস্তারিত। যদিও তাদের কারও কারও বর্ণনা শুদ্ধতার মানদ-ে উত্তীর্ণ নয়; কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইসরা ও মেরাজের হাদিসের ব্যাপারে উম্মাহর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু কাফেররাই একে অস্বীকার করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা আল্লাহর জ্যোতি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ নিজ জ্যোতিকে পূর্ণতায় পৌঁছাবেনই; যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’ (সুরা তওবা : ৩২)।

ইসরা ও মেরাজের ঘটনা

রাসুল (সা.) সাহাবিদের কাছে সে রাত সম্পর্কে বর্ণনা করেন, যে রাতে তাকে ভ্রমণ করানো হয়েছে; সে হাদিসের অংশবিশেষ এইÑ রাসুল (সা.)-এর কাছে একটি বোরাক নিয়ে আসা হলো। বোরাক একটি চতুষ্পদ জন্তু। গাধার চেয়ে বড় ও খচ্চরের চেয়ে খানিকটা ছোট। দৃষ্টির প্রান্তসীমায় তার খুরের ঝলক দেখা যায়। রাসুল (সা.) তাতে আরোহণ করে বাইতুল মাকদিসে এলেন। সেখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করলেন। এর মধ্যে জিবরাইল (আ.) দুটি পাত্র নিয়ে এলেন তার কাছে। একটিতে মদ, অপরটিতে দুধ। রাসুল (সা.) দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলেন। জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘আপনি সুস্থ প্রকৃতির পরিচয় দিয়েছেন।’ এরপর তাকে আসমানে আরোহণ করানো হলো। প্রতিটি আসমানেই সেখানে অবস্থানরত আল্লাহর নৈকট্যশীলরা রাসুল (সা.)-কে স্বাগত জানালেন। আসমানে পূর্ববতী নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। আদম (আ.)-এর ডানে একদল লোক দেখতে পেলেন, বামে আরেক দল। ডান দিকে তাকিয়ে রাসুল (সা.) হাসলেন, বাম দিকে তাকিয়ে কাঁদলেন। জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘এগুলো আদম-সন্তানের আত্মা। জান্নাতিরা ডানে রয়েছে, জাহান্নামিরা বামে।’ তিনি বাইতুল মামুর পরিদর্শন করলেন। প্রতিদিন তাতে সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করেন। তারা আর পুনরায় প্রবেশের সুযোগ পান না। এরপর রাসুল (সা.)-কে সিদরাতুল মুনতাহার দিকে তুলে নেওয়া হলো। সিদরাতুল মুনতাহাকে যে জিনিস আচ্ছাদিত করে রেখেছিল, তার দর্শন ঘটল। এরপর তুলে নেওয়া হলো আরও উচ্চ স্তরে। সেখানে তিনি কলমের আওয়াজ শুনতে পেলেন; আল্লাহর নির্দেশে যেগুলো সৃষ্টিকুলের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করছিল।

এরপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতার মাধ্যম ছাড়া সরাসরি ওহির মাধ্যমে প্রতিদিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হলো। তিনি বারবার আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করে সহজতার আবেদন করলেন। একপর্যায়ে আল্লাহ পঞ্চাশ ওয়াক্তকে পাঁচ ওয়াক্তে নামিয়ে আনলেন। তবে সওয়াবের দিক দিয়ে এটাই পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমান। এর সঙ্গে দেওয়া হলো সুরা বাকারার শেষ আয়াতগুলো। উম্মতের মধ্যে যারা শিরক না করবে, তাদের ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া হলো। এরপর রাসুল (সা.)-কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হলো। সেখানে তিনি মণিমুক্তা ও মিশকের টিলা দেখতে পেলেন। এরপর পৃথিবীতে ফিরে এলেন। মসজিদে আকসায় সব নবীর ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করলেন।

হাফেজ ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘বিশুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে, জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.)-কে প্রত্যেক নবী সম্পর্কে অবগত করছিলেন, যাতে তিনি পরিচিতিমূলক সালাম দিতে পারেন।’ হাদিসে এটাও এসেছে, তিনি নবীদের সঙ্গে মসজিদে আকসায় প্রবেশের আগে মিলিত হয়েছেন। কিন্তু অধিক বিশুদ্ধ হলো, তিনি নবীদের সঙ্গে বিভিন্ন আসমানে সাক্ষাৎ করেছেন। এরপর আবার বাইতুল মাকদিসে এসেছেন। এই দ্বিতীয়বার আসার সময় নবীরা তার সঙ্গে ছিলেন। এ সময় তিনি নবীদের নিয়ে নামাজ আদায় করেন। এরপর রাসুল (সা.) বোরাকে চড়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন।’ (বোখারি : ৩৮৮৭, মুসলিম : ২৬৩)।

ইসরা ও মেরাজের তাৎপর্য

মেরাজের ঘটনা রাসুল (সা.)-এর মধ্যে নিশ্চিত জ্ঞানের পাশাপাশি চাক্ষুষ দর্শনেরও সমন্বয় ঘটিয়েছে। সংযোগ সৃষ্টি করেছে নবুয়তের প্রথম পুরুষদের সঙ্গে সর্বশেষ নবীর। আদম (আ.) থেকে নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত ঈমান ও তাওহিদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে। এর সবকিছু হয়েছে রাতের সামান্য একটি অংশে। এ সত্ত্বেও আল্লাহতায়ালা এর দ্বারা নবুয়ত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে দলিল স্থাপন উদ্দেশ্য নেননি। কারণ, এ নৈশভ্রমণ সংঘটিত হয়েছে রাতে। মানুষ তখন ঘুমিয়েছিল। মক্কার কেউ জানতে পারেনি। আল্লাহর ইচ্ছে ছিল, রাসুল (সা.)-কে তার বড় বড় নিদর্শন প্রত্যক্ষ করাবেন। তিনি পবিত্র ও মহান সত্তা, মহাশক্তিধর, সীমাহীন বড়ত্বের অধিকারী। তাঁর কাছে অসম্ভব কিছু নেই। কেউ তাঁর শক্তির অনুমান করতে পারে না। যে সত্তা রানী বিলকিসের সিংহাসনকে চোখের পলকে ইয়েমেন থেকে বাইতুল মাকদিসে হাজির করতে পারেন, কে তার শক্তির পরিধি আয়ত্ত করতে পারে? যে শক্তি মুসা (আ.)-এর লাঠিকে এমন জীবন্ত সঞ্চারমান সাপে রূপান্তরিত করতে পারেন, যা জাদুকরদের রশি ও লাঠিকে মুহূর্তে গিলে ফেলে; কোন সে বুদ্ধি, যা তার সে শক্তির পরিমাণ পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারে? ইব্রাহিম (আ.)-এর ছিন্নভিন্ন করা পাখি, যার একেক টুকরো রাখা হয়েছিল একেক পাহাড়ে; যখন তিনি ডাক দিলেন, তা জীবিতরূপে ফিরে এলো; যেই সত্তা এই পাখির মাঝে আত্মার সঞ্চার করলেন, কার সাধ্য তার কুদরত পূর্ণ বুঝতে পারে? তিনি পবিত্র সত্তা, মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। তাঁর কাছে কিছুই অসম্ভব নয়।

শবেমেরাজের কিছু নির্দেশনা

যে রাতে ইসরা ও মেরাজ সংঘটিত হয়েছে, সে রাতে কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। এ রাতের জন্য বিশেষ কোনো ইবাদত নির্ধারণ করা যাবে না। কারণ, এ রাতের জন্য ইবাদত নির্ধারণ সংক্রান্ত কোনো বিশুদ্ধ বর্ণনা নেই। না রজবে, না অন্য কোনো মাসে। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘ইসরার রাত যে কোনটি ছিল, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না।’ আল্লামা আবদুল আজিজ ইবনে বাজ (রহ.) বলেন, ‘কোন রাতে ইসরা ও মেরাজ সংঘটিত হয়েছে, বিশুদ্ধ কোনো বর্ণনা দ্বারা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। এমনকি তা রজব মাসে হওয়াটাও নিশ্চিত নয়। এটি নির্দিষ্টকরণের ব্যাপারে যেসব বর্ণনা এসেছে, তা রাসুল (সা.) সূত্রে প্রমাণিত নয়। মানুষকে এটি ভুলিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর অবশ্যই কোনো রহস্য রয়েছে। যদি সেটি নির্দিষ্ট হতো, তাহলেও দলিল ছাড়া এ রাতের জন্য কোনো ইবাদত নির্ধারণ করার সুযোগ ছিল না।’

২৪ রজব ১৪৪৩ হিজরি মোতাবেক ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত