মক্কা থেকে ১৫ মাইল পূর্বে তাইফের পথে অবস্থিত এক মরু ময়দানের নাম ‘আরাফাত’। ময়দানের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত ‘জাবালে রহমত’। ‘আরাফাহ’ শব্দের অর্থ হলো পরিচিতি। হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.) আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত থেকে বের হওয়ার পর পৃথিবীতে পরস্পর পরস্পরকে খুঁজতে খুঁজতে আরাফাতের ময়দানে এসে মিলিত হয়েছেন। এ কারণে ওই স্থানের নাম হলো ‘আরাফাত’।
আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদেরকে গোনাহমুক্ত হওয়ার জন্য যে সমস্ত দিবস দান করেছেন, সে সমস্ত দিনগুলোর মধ্যে ইয়াওমে আরাফা অন্যতম একটি দিন। জিলহজ মাসের ৯ তারিখকে বলা হয় ‘ইয়াউমে আরাফাহ’ বা ‘আরাফাতের দিন’। আরাফাত দিবস অত্যন্ত মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ একটি দিন। আল্লাহতায়ালা বলেন, আর কসম সাক্ষ্যদাতার এবং যার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়া হবে তার। (সুরা বুরুজ : ৩)। ওই আয়াতে এই দিনকে ‘মাশহুদ’ বলা হয়েছে এবং এর কসম খাওয়া হয়েছে। প্রিয় নবীজি (সা.) ‘মাশহুদ’কে আরাফাতের দিন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন (তিরমিজি)।
আরাফার ময়দান ক্ষমা পাওয়ার ময়দান হিসেবেও পরিচিত। শূন্য মস্তকে সেলাইবিহীন বস্ত্র পরিহিত লাখো লাখো আল্লাহ প্রেমিকের কান্নার আওয়াজ এদিন আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে। লাব্বাইকা, লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক- ‘হে প্রভু! বান্দা হাজির, বান্দা হাজির’ বলে আল্লাহর ঘরে হাজিরাদানকারী আল্লাহপ্রেমিকরা এদিন আরাফাতের ময়দানে সমবেত হয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে রাববুল আলামিনের দরবারে কাতর হয়ে ফরিয়াদ জানান। দশম হিজরি সনে এই ময়দানে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হজ উপলক্ষে তাঁর শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে যা বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
ইসলামের মূল স্তম্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হজ। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হলো হজ। আর আরাফাতের দিনটি মূলত হজের দিন। হজরত উরওয়া ইবন মুদারিস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মুজদালিফায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি তায়ি গোত্রের পাহাড়দ্বয় থেকে আগমন করেছি। আর আমি কোনো পাহাড়ে অবস্থান বাদ দিইনি; এমতাবস্থায় আমার কি হজ আদায় হয়েছে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে এই সালাত আদায় করেছে আর এর পূর্বে আরাফায় অবস্থান করেছে- দিনে হোক অথবা রাতে, তার হজ পূর্ণ হয়েছে এবং সে তার ইহরাম শেষ করেছে। (সুনান নাসাঈ-৩০৪৪)।
আরাফাতের দিন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ দিন
আরাফার দিনটি ইসলামে এত মর্যাদাপূর্ণ যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এটাকে ঈদের দিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হজরত উকবাহ বিন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আরাফাতের দিন, কোরবানির দিন এবং তাশরিকের দিনগুলো হচ্ছে ইসলামে আমাদের ঈদের দিন। এ দিনগুলো হচ্ছে পানাহারের দিন। (সুনান আবু দাউদ : ২৪২১)।
আল্লাহতায়ালা এ দিনকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছেন। দ্বীন-ইসলাম পূর্ণতার ঘোষণা দিয়েছেন এ দিনেই। এ দিনেই অবতীর্ণ হয়েছে কোরআনে কারিমের সর্বশেষ আয়াত, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলাম তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। (সুরা মায়েদা : ০৩)।
আরাফাত দিবসের ফজিলত
আরাফাত দিবসে বান্দার দিকে আল্লাহতায়ালার রহমতের জোয়ার প্রবল বেগে উৎসারিত হয়। অসংখ্য বান্দাকে তিনি ক্ষমা করে থাকেন এ দিনে। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের মতো আর কোনো দিন এত অধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় না। আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার নিকটবর্তী হন এবং বান্দাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন। আল্লাহ বলেন, কী চায় তারা? (সহিহ মুসলিম-১৩৪৮)।
হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত আরেক বর্ণনায় রয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা নিকটতম আসমানে আসেন এবং পৃথিবীবাসীকে নিয়ে আসামানের অধিবাসী অর্থাৎ ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ব করেন। বলেন, দেখ তোমরা- আমার বান্দারা উশকোখুশকো চুলে, ধুলোয় মলিন বদনে, রোদে পুড়ে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে সমবেত হয়েছে। তারা আমার রহমতের প্রত্যাশী। অথচ তারা আমার আজাব দেখেনি। ফলে আরাফার দিনের মতো আর কোনো দিন এত অধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় না।’ (ইবনে হিব্বান : ৩৮৫৩)।
এ দিবসের একটি রোজায় বান্দার দুই বছরের গোনাহ মাফ হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের (৯ জিলহজের) রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা রাখি যে, তিনি আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন। (মুসলিম : ১১৬২)।
আরাফার দিন প্রতিশ্রুতি গ্রহণের দিন
আরাফার দিন এমন দিন, যেদিন আল্লাহতায়ালা বনি আদম থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা আরাফার ময়দানে- আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। তিনি আদমের মেরুদণ্ডে তাঁর যত বংশধরকে রেখেছেন, তাদের সবাইকে বের করে এনে অণুর মতো তাঁর সামনে ছড়িয়ে দেন। এরপর সরাসরি তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন : আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা সবাই বলে : হ্যাঁ অবশ্যই; আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা এ জন্য যে, তোমরা যেন কেয়ামতের দিন না বল, ‘আমরা তো এ বিষয়ে গাফেল ছিলাম। কিংবা তোমরা যেন না বল, আমাদের পিতৃপুরুষরাও তো আমাদের আগে শিরক করেছে, আর আমরা তো তাদের পরবর্তী বংশধর; তবে কি (শিরকের মাধ্যমে) যারা তাদের আমলকে বাতিল করেছে, তাদের কৃতকর্মের জন্য আপনি আমাদেরকে ধ্বংস করবেন।’ [সুরা আরাফ : ১৭২-১৭৩, (মুসনাদে আহমাদ)]।
আরাফাতের দিনের শ্রেষ্ঠ দোয়া
হাদিস শরিফে আরাফাতের দিনের দোয়াকে শ্রেষ্ঠ দোয়া বলা হয়েছে। নবীজি (সা.) বলেন, শ্রেষ্ঠ দোয়া আরাফাতের দোয়া। দোয়া হিসেবে সর্বোত্তম হলো ওই দোয়া, যা আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীরা করেছেন। তা হলো- ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলক ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শায়ইন কাদির।’ অর্থ : ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি একক, তার কোনো শরিক নেই, রাজত্ব একমাত্র তারই, সব প্রশংসাও একমাত্র তারই জন্য, আর তিনি সব বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। (তিরমিজি-৩৫৮৫; শুআবুল ঈমান-৩৭৭৮)।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল
অ্যান্ড কলেজ