ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

আত্মিক প্রশান্তির মর্মকথা

শায়খ ড. সাউদ বিন ইবরাহিম আশ শুরাইম
আত্মিক প্রশান্তির মর্মকথা

উত্থান-পতন জীবন-বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, উজ্জ্বলতা ও মলিনতা। দুঃখের পরে সুখ আসে, সুখের পরে আসে দুঃখ। জীবনে সম্মুখীন হতে হয় নানামুখী সংকটের। জীবনের নানা ক্ষেত্রে মানুষকে ঘিরে থাকে নানা ঝড়-ঝাপ্টা, ব্যথা-বেদনা, দুঃখ-দুশ্চিন্তা ও সংকীর্ণতা। একের পর এক বিপদের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে অনেক সময় সুখের দেখা যেন মেলেই না। মধু মনে হতে থাকে তিক্ত, বিস্বাদ। সুমিষ্ট পানি কড়া লবণাক্ত লাগে।

আত্মিক প্রশান্তি শ্রেষ্ঠ নেয়ামত

আত্মিক প্রশান্তি পার্থিব জীবনে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামতগুলোর একটি। যে এর স্বাদ উপভোগ করেছে, সে যেন সবকিছু পেয়েছে। যে তা হারিয়েছে, তার যেন কিছুই নেই। কর্মহীনতা, অলসতা ও স্থবিরতাকে আত্মিক প্রশান্তি ভেবে নেওয়ার সুযোগ নেই; বরং প্রশান্তি বা সুখ তো হৃদয়বৃত্তির চর্চা ও কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে, কর্মই মূলত সুখ টেনে আনে।

সুখের প্রকৃত সংজ্ঞা

এখানে আরবি ‘বাল’ শব্দটি লক্ষ্যণীয়। যার অর্থ- অবস্থা, পরিস্থিতি, হৃদয়। শব্দটিকে যেদিকে সম্বন্ধিত করা হয়, সে হিসেবে এর অর্থ ধরা হয়। বলা হয়- অমুক সুখে আছে, প্রাচুর্যে ভরপুর জীবন তার, মনে শান্তি আছে। কারও অবস্থা থাকে অনুজ্জ্বল, নিষ্প্রভ। কেউ ব্যস্ততার মাঝে ডুবে থাকে। কারও অবস্থা হয় বিশৃঙ্খল, অশান্ত। নিজের জন্য একটি সুখময় অবস্থা রচনা করা বুদ্ধিমানের প্রধান লক্ষ্য। এতেই রয়েছে তার কল্যাণ ও জীবনের উজ্জ্বলতা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা কুফরি করবে, আল্লাহর পথে চলতে বাধা দেবে, আল্লাহ তাদের কর্মকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবেন। আর যারা ঈমান এনে সৎকর্ম করবে এবং মুহাম্মদের ওপর যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবে; বস্তুত তাণ্ডই রবের পক্ষ থেকে আসা প্রকৃত সত্য। আল্লাহ তাদের ভুলগুলো ক্ষমা করে দেবেন। তাদের অবস্থা সুন্দর করে দেবেন।’ (সুরা মুহাম্মদ : ১-২)।

মনের শুদ্ধতা সুখের অন্যতম কারণ

বিদগ্ধজনরা একমত যে, জীবনে একটি সুখময় অবস্থা রচনা করা মানুষের অন্যতম লক্ষ্য। সেজন্য আত্মিক প্রশান্তি প্রয়োজন; কোনো ধরনের হইচই যাতে বিঘœ ঘটাবে না। প্রয়োজন স্বচ্ছ হৃদয়; মলিনতা যাকে স্পর্শ করবে না। যাতে সুখময় অবস্থা সৃষ্টি হয়, এমন উপায়-উপকরণ গ্রহণ করতে হবে। একে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, এমন সব কর্মপন্থা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। আত্মিক সংকীর্ণতা, অস্থিরতা, সংকট, বিবাদণ্ডবিসংবাদ, ইতিবাচক ধারণার ওপর নেতিবাচক ধারণার প্রাবল্য- সুখময় অবস্থা রচনায় বাধাস্বরূপ। সুখণ্ডদুঃখের মূল কেন্দ্রবিন্দু হৃদয়। হৃদয় যদি বিশুদ্ধ, সচেতন ও সজাগ হয়, সে সুখের স্বচ্ছ শরাব পরিবেশন করবে। পরিবেশকে ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে মুক্ত করা যদি মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে অন্তরকে বিষণœ করে যেসব কারণ, তা থেকে তাকে মুক্ত করাটাও অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য, দ্বিতীয়টি নিজের সুখময় অবস্থার বিঘœ দূর করার জন্য।

যারা মনের সুখ লাভ করতে পারে না

যে অন্যের নিন্দা করে নিজে প্রশংসা কুড়াতে চায়, যে অন্যকে নিচু করে নিজেকে উঁচুতে দেখতে চায়, যে নিজের ঘর আলোকিত করার জন্য অন্যের ঘর অন্ধকার করে দেয়, যে একমাত্র নিজে কথা বলার জন্য অন্যকে চুপ করিয়ে দেয়, যে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে নিজে তার কোষ খেতে চায়, সে কখনোই আত্মিক প্রশান্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে না। যে নিজের সঙ্গে ও মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়া ঠিক করে না নেয়, মানুষের সঙ্গে লড়াই-ঝগড়া থেকে মুক্ত না হয়, সেও কিছুতেই পায় না মনের সুখ। যে কৃত্রিমতা পরিহার না করে, যা সে নয় তেমন বেশভূষা ধারণ করে এবং নিজের স্তর ও মর্যাদা অনুযায়ী না চলে অন্যের চালচলনে নিজেকে উপস্থাপন করে, হৃদয়ের প্রশান্তি স্পর্শ করে না, তাকেও। প্রতিটি মুসলমানের নিজের মূল্য বুঝতে হবে। সব ধরনের অর্থবহ কাজের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। শরীর ও মন ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমন সবকিছু থেকে দূরত্ব অবলম্বন করতে হবে। হিংসুক কখনও মনে শান্তি পায় না। মনে শান্তি পায় না চোগলখোরও। হৃদয় যার বিদ্বেষে পরিপূর্ণ, আত্মিক প্রশান্তি তার থেকে শত গজ দূরে। আল্লাহতায়ালা শুধু পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারীকেই আত্মিক প্রশান্তি দান করে থাকেন। হৃদয় যার আল্লাহভীতিতে পূর্ণ, কলুষমুক্ত, যে হৃদয়ে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নেই, পাপাচার নেই, সেটিই মূলত পরিচ্ছন্ন হৃদয়।

আত্মিক প্রশান্তি হৃদয়ানুভূতির নাম

সুখণ্ডশান্তি আল্লাহর বড় নেয়ামত, অপার দান। সবাই এটি লাভ করতে পারে না। টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না। গরিব হলেই যে সুখণ্ডবঞ্চিত হবে, এমন কথা নেই। দুনিয়ার চাকচিক্য সুখ বয়ে আনতে পারে না। সম্পদ ও ক্ষমতার চূড়ান্তে থেকেও অনেকে অসুখী হতে পারে। দারিদ্র্য ও সংকট যতই তীব্র হোক, সুখের জন্য কোনো বাধা নয়। গাছতলায় রাতযাপন করেও অনেকে সুখের দেখা পেতে পারে। আবার দশতলায় আরামণ্ডআয়েশে বাস করেও কেউ সুখণ্ডবঞ্চিত হতে পারে। সুখ একটি হৃদয়ানুভূতির নাম। এটি লাভ করতে হলে হিংসা-বিদ্বেষ ও স্বার্থপরতার সমুদ্রের ওপর একটি মজবুত সেতু নির্মাণ করতে হবে।

এ সেতু পেরিয়ে পার্থিব জীবন অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে হবে পরকালীন সফলতার দিকে। হতে হবে পরদুঃখে দুঃখী এবং পরিশুদ্ধ ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী। যখন রাত নামে, আঁধারের পর্দা টানিয়ে দেওয়া হয় দিবসের আলোর ওপর, সুখী মানুষ তখন বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে। হারিয়ে যায় গভীর নিদ্রায়। দুশ্চিন্তা তার নিদ্রা ভাঙতে পারে না। বিনিদ্রারোগ তার নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না।

সুখ লাভের সহজ পথ

জীবন যতই দীর্ঘ হোক, বাস্তবে তা ছোট। কোরআনের ছোট তিনটি আয়াতে জীবনের সংক্ষিপ্তরূপ কী সুন্দরভাবেই না ধরা পড়ে। মানুষ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শুক্রবিন্দু থেকে তিনি তাকে সৃষ্টি করেন। এরপর তার পরিমিত বিকাশ সাধন করেন। তারপর তার জন্য (পৃথিবীতে আসার) পথ সহজ করে দেন। অতঃপর তার মৃত্যু ঘটান ও তাকে সমাধিস্থ করেন।’ (সুরা আবাসা : ১৯-২১)। জীবন সম্পর্কে এর থেকে বেশি কিছু বলার নেই। সবকিছু আল্লাহর হাতে। তিনি যা চান, তা হয়। যা চান না, হয় না। ভাগ্যে যা আছে, পৃথিবীর কেউ সেটি না চাইলেও আসবেই। ভাগ্যে যা নেই, কারুনের সমান সম্পদের অধিকারী হলেও তা তার কাছে ধরা দেবে না। যা চলে গেছে, তা চলে গেছে; কখনোই তা ফিরে আসবে না। ভবিষ্যতের বসবাস অদৃশ্য জগতে। আল্লাহ ছাড়া কেউ সে সম্পর্কে অবগত নয়। মানুষ শুধু বর্তমানকেই কাজে লাগাতে পারে। জ্ঞানীরা সুখী মানুষের তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন- যা পায়নি, তার জন্য রবের ওপর ভরসা করে। যা পেয়েছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। যা হারিয়েছে, তার জন্য ধৈর্য ধারণ করে। এ সঠিক বুঝই একজন মানুষকে সুখের চাদরে জড়িয়ে রাখতে পারে। এনে দিতে পারে অফুরান শান্তি, পরিচ্ছন্ন জীবন।

সুখী জীবনের মূলমন্ত্র

জীবনে সুখকে স্থায়ী করতে চাইলে চারটি বিষয় সর্বদা উপলব্ধিতে রাখতে হবে-

এক. মৃত্যু থেকে কারোরই নিষ্কৃতি নেই। যতই তার থেকে পালানোর চেষ্টা করা হোক, তার সম্মুখীন হতেই হবে। কারণ, মৃত্যু তাকে সামনের দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করছে, পেছন দিক থেকে নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পলায়ন করছ, অবশ্যই তোমাদের তার সম্মুখীন হতে হবে।’ (সুরা জুমা : ৮)। এ ক্ষেত্রে আলী (রা.)-এর বক্তব্যটিও সদা স্মরণযোগ্য। তিনি বলেন, ‘জীবনের যে কোনো দুটি দিনের কোন দিনে আমি মৃত্যু থেকে পলায়ন করব? যেদিন আমার জন্য মৃত্যু লেখা হয়নি, নাকি যেদিন লেখা হয়েছে? যেদিন মৃত্যু লেখা হয়নি, সেদিনকে আমি ভয় করি না। আর যেদিন আমার মৃত্যু লিখে রাখা হয়েছে, সেদিন মৃত্যুকে ভয় করা বা মৃত্যু থেকে পলায়ন আমাকে মুক্তি দিতে পারবে না।’

দুই. পার্থিব জীবনে স্থায়ী সুখ অসম্ভব। দিনগুলো আবর্তিত হতে থাকে। কখনও সুখের সময় আসে, কখনও দুঃখের সময়।

তিন. মানুষের অনিষ্ট থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পাওয়ার কোনো পথ নেই। মানুষকে যত এড়িয়ে চলা হোক, যতই নির্জনতা অবলম্বন করা হোক, তাদের থেকে মুক্তি যেন সোনার হরিণ। প্রাচীন এক আরবি কবি বলেন, ‘নিন্দুকের বাড়ি যদি ইয়ামামায়ও হয়, আর আমার বাড়ি যদি হয় হাজারা মৌতের উঁচু ভূমিতেও, তবুও তার থেকে বেঁচে থাকা অসম্ভব।’ অনেকে মনে করে- সুখ বুঝি নির্জনতায়, লোকালয়ে নয়; সুখ কর্মহীনতায়, পরিশ্রমে নয়। এটা সুস্পষ্ট ভুল। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মোমিন মানুষের সঙ্গে মেশে, তাদের দেওয়া কষ্টে ধৈর্য ধারণ করে, সে তার চেয়ে উত্তম, যে মানুষের সঙ্গে মেশে না ও তাদের দেওয়া কষ্টে ধৈর্য ধারণ করে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০৩২)।

চার. রবের ফয়সালায় যে সন্তুষ্ট হয় না, সে কখনও সুখ লাভ করতে পারে না। আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট থাকা, তার ফয়সালা খুশি মনে মেনে নেওয়া আত্মিক প্রশান্তির অন্যতম ভিত্তি। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গতভাবে ঈমান ও তার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টির মাঝে সুখণ্ডশান্তি নিহিত রেখেছেন। আর দুঃখ-বেদনা নিহিত রেখেছেন সংশয়বাদিতা ও তার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টির মাঝে।’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে ও মুহাম্মদ (সা.)-কে নবী হিসেবে সন্তুষ্টির সঙ্গে গ্রহণ করে, সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করে।’ (মুসলিম : ৩৪)।

আত্মিক প্রশান্তি লাভে করণীয়

চারটি বিষয়ের মধ্যে সমগ্র সুখের সন্ধান পাওয়া যায়-

এক. বেশি পরিশ্রম করে শরীরকে অকেজো করা যাবে না, আবার কাজ না করে বা কম করে অলসতাও করা যাবে না।

দুই. আত্মাকে পাপাচার থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।

তিন. হৃদয়কে দুনিয়ার চিন্তা-ভাবনায় কম নিমগ্ন করতে হবে।

চার. জবানকে অশ্লীল, অনর্থক ও নিজের জন্য মর্যাদাহানিকর কথাবার্তা থেকে বিরত রাখতে হবে। সুখের সন্ধান পাওয়া যাবে পরিশুদ্ধ অন্তরে, উত্তম আচরণে, মানুষকে কষ্ট না দেওয়ায়, বেদনাহতের অশ্রু মুছিয়ে দেওয়ায়, পিতৃহীনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ায়, সততায়, বিশ্বস্ততায়, বিনয়ে, সন্তুষ্টিতে। মূর্খদের এড়িয়ে যেতে হবে। বোকাদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়া যাবে না। আত্মিক প্রশান্তির নব্বই ভাগ মূলত এগুলোর মাঝেই নিহিত।

৭ মহররম ১৪৪৪ (৫ আগস্ট ২০২২) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত