চার কদম এগিয়ে গেলেন। সজোরে পা চালালাম। পিছু নিলাম তার। চারপাশে পাখির কিচিরমিচির ডাক। সুনসান নীরবতা। কাকডাকা ভোরের স্নিগ্ধ কোমল পরশ। সব মিলিয়ে অন্যরকম ভালোলাগা। নির্মল স্বচ্ছ হাওয়া গায়ে লাগছে। ততক্ষণে তার কাছাকাছি চলে এলাম। মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার তো ডায়াবেটিস, আপনি হাঁটেন কেন?’ কথার শুরু এভাবে। নাম তার মাওলানা ফরিদ আহমদ। সবাই তাকে ‘রুপসা হুজুর’ বলে চেনে। তখনও তার সঙ্গে আমার তেমন সখ্য গড়ে ওঠেনি। সবে পা রেখেছি গওহরবাগে। ‘দেওবন্দেও কী এভাবে রোজ হাঁটতেন?’ প্রশ্ন করে বসলাম। ‘দেওবন্দের জিন্দেগি এক আজিব জিন্দেগি ছিল। সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’ বলে মুচকি হাসলেন। গা বেয়ে ঘাম ঝরছে তার। আমরা এসে দাঁড়ালাম মধুমতি সেতুর ওপর। ভোরের কী দারুণ ভালো লাগা! তার ওপর রুপসা হুজুরের ছোট্ট করে বলা কথা! অন্যরকম লাগছে। ‘হুজুর! বয়স কত হলো? বিয়েশাদির ফিকির করেন না কেন?’ আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন। লাজুকতার পরিচয় দিয়ে এড়িয়ে গেলাম। পাশঘেঁষে ছুটল গাড়ির বহর। হুজুরের হাত ধরে রাস্তা পার হলাম। হাঁটা ধরলাম ফের গওহরডাঙ্গার উদ্দেশে।
এভাবেই রোজ ভোরে একসঙ্গে হাঁটতাম। নানান আলাপে আমাদের সময়টা বেশ কাটত। কখনও আমাদের সঙ্গী হতেন গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি মাহবুবুর রহমান (ভাঙ্গা হুজুর), কখনও বা মুফতি ইমরান হুসাইন (নাটোরের হুজুর)। একদিন সহকর্মীদের কয়েকজন আমাকে বললেন, ‘হুজুর! রুপসা হুজুর অনেক মুরব্বি মানুষ। সিনিয়র লোক। আমাদের উস্তাদ। তার সঙ্গে হাঁটতে বের হওয়া কী উচিত হবে?’ আমি চেহারায় হাসির রেখা টেনে বললাম, ‘আমি তার কাছে পড়িনি; কিন্তু আমাকেও তার ছাত্র মনে হয়। অথচ তিনি তার আচরণে কোনোদিন সেটা বুঝতে দেন না। আমার তো তার সঙ্গে হাঁটতে বেরুতে ভালোই লাগে।’ সেই থেকে সম্পর্কের শুরু। আমি গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার ফতোয়া বিভাগে সকালে ঘণ্টা দেড়েকের মতো নেগরানি করতাম। হুজুর মোতালা শেষে মাঝেমধ্যে ফতোয়া বিভাগ হয়ে যেতেন। আমি তাকে দেখে দরসের বাইরে চলে আসতাম। হুজুর কথা বলতেন। হালপুরসি করতেন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ভালোবাসতেন। বিভিন্ন মাসআলা নিয়ে দলিলভিত্তিক আলোচনা করতেন। একবার বাদ ফজর আমার নেগরানি পড়ল। আমি সারা মাদ্রাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কোথাও কোনো ছাত্র পেলাম না, শুধু হুজুরের রুমে কয়েকজন ছাত্রকে দেখলাম মোতালায় ব্যস্ত। ওদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কার অনুমতিতে মসজিদে না বসে এখানে?’ ওরা থতমত খেয়ে গেল। কিছু বলল না। বিষয়টি হুজুরকে জানালাম। হুজুর বললেন, ‘ওরা মোতালার ছাত্র। ভালো পড়াশোনা করে। রুমে এসে আমল করে।’ আমি কিছু বললাম না। রুপসা হুজুর মেপে মেপে কথা বলতেন। যেখানে যতটুকু বলা দরকার, ঠিক ততটুকুই বলতেন। বাড়ানো, কমানো পছন্দ করতেন না। হুজুরের মুখের ওপর কিছু বলিনি। কয়েকদিন পর জানতে পারলাম, হুজুর তাদের আমলের ব্যাপারে আলাদাভাবে নজর দেন। তারা ভালো ছাত্র, সেজন্য হুজুরের স্পেশাল তদারকি রয়েছে তাদের ওপর। আমি মোটেও এতে অবাক হলাম না। আপবিতির কথা মনে পড়ে গেল। শায়খ জাকারিয়া (রহ.)-এর ছাত্রজীবনের চিত্রও এমনটি ছিল।
গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় একবার ভারত থেকে মাওলানা সালমান মানসুরপুরী এলেন। মসজিদে সবাই সমবেত হলো। ছাত্র-শিক্ষক এবং বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে আগত লোকজনে গোটা মসজিদ কানায় কানায় ভরে উঠল। আমি পেছনে কোনোমতে বসে পড়লাম। বাঁশবাড়িয়ার হুজুর আমার নাম ধরে ডাকলেন। বললেন, ‘মুনশি সাহেব! হুজুরের উর্দু আলোচনার অনুবাদ করেন।’ মানসুরপুরী সাহেব তার কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেলেন। আমি সবটা শুনে সংক্ষেপে বিশুদ্ধ উচ্চারণে তা সবার সামনে উপস্থাপন করলাম। আমার সেই অনুবাদ সবার নজর কাড়ল। বেশ প্রশংসিত হলাম। অনেকে বাহবা দিলেন। এর কিছুদিন পরের ঘটনা। হুজুর কোনো এক কাজে মাদ্রাসার বোর্ডিংয়ে এলেন। আমি ফতোয়া বিভাগের নেগরানি শেষে আদব বিভাগের উদ্দেশে আসছিলাম। বোর্ডিংয়ের কাছে এসে হুজুরের সঙ্গে দেখা। সালাম দিলাম। কুশল বিনিময় করলাম। হুজুর আমার হাত ধরে বললেন, ‘মাওলানা! কী খবর? কেমন চলছে? দুটো কথা বলব। সময় আছে?’ আমি বাধ্যগত শিষ্যের মতো আদবের সঙ্গে দাঁড়ালাম। হুজুর বললেন, ‘আপনার উর্দু এবং বাংলা চর্চাটা ধরে রাখুন। এর দ্বারা অনেক খেদমত আঞ্জাম দিতে পারবেন।’ সে সময় পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক রোজনামা পাকিস্তানে আমার দুই পৃষ্ঠাব্যাপী একটা কলাম ছাপা হয়। উর্দুভাষার বিপ্লবী কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে নিয়ে লেখা আমার সেই কলামটি হুজুরকে দেখাই। হুজুর হাঁটতে হাঁটতে মাদ্রাসার গেট পেরিয়ে তার বাসার বারান্দা পর্যন্ত ঠেকলেন। বললেন, ‘মাওলানা! অসাধারণ আপনার গদ্যরীতি। মাশাআল্লাহ, আমাকে লেখাটি প্রিন্ট করে দেবেন?’ আমি হুজুরকে সেই লেখাটি প্রিন্ট করে দিয়েছিলাম কি-না, তা আমার এখন মনে নেই। তবে এতটুকু মনে পড়ে, তিনি আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘উর্দু কি চাশনি হি আলাগ হে।’ আমি হাস্যোজ্জ্বল চোখে সায় দিতাম। একদিন চাঁদনি রাত। সম্ভবত বাদ এশা। গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মাঠে আমরা দু’জন কথা বলছি। নানান প্রসঙ্গ তুলছেন হুজুর। গওহরবাগের পড়ালেখার আদ্যোপান্ত, সদর সাহেব হুজুর (রহ.)-এর কারনামা, গওহরের বর্তমান ইতিহাস-ঐতিহ্য। আমি চুপ করে শুনছিলাম। হঠাৎ একটা ফোন এলো। হুজুর চুপ হয়ে গেলেন। এতক্ষণ যতটা জোশে কথা বলছিলেন, সেটা আর রইল না। জানি না, সেদিন কার সঙ্গে কী কথা হয়েছিল হুজুরের। তবে হুজুরের সঙ্গে আলাপ করে দারুণ লাগত। তিনি ছিলেন সদালাপী। ছাত্রদের প্রতি যথেষ্ট স্নেহশীল। তার হাতেগড়া প্রচুর ছাত্র বাংলার নানান সেক্টরে নানান পেশায় দ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছেন। গত বুধবার সংসদ অ্যাভিনিউ মসজিদের খতিব মুফতি আলী হায়দার ভাইয়ের একটা ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখলাম। অনেকটা নড়েচড়ে বসলাম। তখন উত্তরা থেকে নাবিস্কো ফিরছি। তাকে ফোন দিলাম। উনি বললেন, ‘হুজুরের হালত গুরুতর।’ এরপর গওহরডাঙ্গার কয়েকজন শিক্ষকের ফেইসবুক স্ট্যাটাস নজরে এলো। আমার কেন যেন মনে হলো, হুজুরের সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না। মিলবে না আর একজন সাদামনের মানুষের সদালাপ। তিনি যেমন একজন আদর্শ উস্তাদ ছিলেন, তেমনি ছিলেন সহকর্মীদের একজন উত্তম সঙ্গী।
মনে পড়ে, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ কার্যক্রমে গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা থেকে বিশাল উদ্যোগ নেওয়া হলো। গওহরডাঙ্গার ছাত্রদের পালাক্রমে একে একে পাঠানো হতো। একপর্যায়ে আমার পালা এলো। আমি ছাত্রদের নিয়ে গেলাম কক্সবাজার। সেখানকার ডলফিন মোড়ের হোটেলে আমাদের অবস্থান ছিল। রোজ সকাল হলেই ছুটে যেতাম ত্রাণ কাজে। দিনশেষে ক্লান্ত মনে ফিরতাম হোটেলে। আমি তখন ফেইসবুকে নিয়মিত তাদের কারগুজারি লিখতাম ‘রোহিঙ্গা শিবিরের বাঁকে বাঁকে’ শিরোনামে। গওহরডাঙ্গার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম মুফতি উসামা আমিন তা নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। আমার একান্ত প্রিয় ছাত্র সাদ্দাম হাওলাদার এসে সেটা আমাকে জানাত। দিনশেষে সেই স্ট্যাটাস দিতে দেরি হলে ওদের তিনি বলতেন, ‘মুনশি সাহেবের বাঁকে বাঁকে কই?’ আমি তড়ঘড়ি লিখে পোস্ট করতাম। আমার এ লেখার আরেকজন অন্ধভক্ত ছিলেন রুপসা হুজুর। একদিন সাদ্দাম খবর দিল, ‘হুজুর! আজ রুপসা হুজুর কক্সবাজার আসবেন।’ খুশি হলাম। তাকে দেখলেই কেমন যেন ভালোলাগা কাজ করত। আমাকে দেখলে কিছু না কিছু বলতেনই তিনি। যা আমার বড় উৎসাহের কারণ হতো।
প্রতিদিনের মতো সকালবেলা আমরা স্পটে গেলাম। সেদিন আমাদের কার্যক্রম ছিল ঘর তৈরির। কাজবাজ শেষে সিদ্ধান্ত হলো, আমরা রোহিঙ্গাদের ধ্বংসস্তূপ দেখতে টেকনাফের একদম শেষ পর্যন্ত যাব। যেই ভাবা সেই কাজ। গাড়ি হাঁকানো হলো টেকনাফের দিকে। বর্ডার ক্রস করে গেলাম নাফ নদের তীরে। আমি হুজুরের হাত ধরে ট্রলারে তুললাম। নদ অনেকটা মরা। আমরা চর পেরিয়ে ছুটলাম গন্তব্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছুলাম দ্বীপে। দূরেই নজরে পড়ল সেন্টমার্টিন। হুজুর বললেন, ‘লেখক হুমায়ূন আহমেদ নাকি ওখানে বাড়ি করেছেন?’ মাথা নাড়ালাম। আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম একদম শেষ প্রান্তে। দেখলাম, আগুন জ্বলছে মিয়ানমারের বর্ডারে। হুজুর বড় আবেগী মানুষ। দ্বীপের শেষ প্রান্তের সেতুতে দাঁড়িয়ে অশ্রু ফেললেন। টপটপ করে ঝরে পড়া তার সেই অশ্রু আজও আমার চোখে ভাসে। কতটা মানবিক, সামাজিক হলে মানুষের জন্য মানুষের কান্না আসে, সেটা হুজুরকে না দেখলে জানাই হতো না। হুজুর এতটুকুতে ক্ষান্ত হননি, পাশের দু-চারজনকে ডাকলেন। জানতে চাইলেন, কীভাবে কী ঘটেছে? আর এখন কী পরিস্থিতি তাদের। লোকজন রেহিঙ্গাদের মর্মান্তিক গল্প শোনাল। বড় অবাক হলাম, তখন ছিল ভরদুপুর। মাথার ওপর সূর্যটা প্রচণ্ডরকম রেগে আছে। ছাতা নেই কোনো। রোদের তাপে আমরা অনেকটা বিষিয়ে উঠেছি। কিন্তু হুজুরের কোনো ক্লান্তি নেই। তিনি পুরো গল্প শুনে তবেই ফিরলেন।
পরদিন আমরা ত্রাণ কাজ শেষে ইনানী বিচে নামলাম। মাগরিব ছুঁইছুঁই তখন। হুজুর আমাকে বললেন, ‘দেখেন মাওলানা! আল্লাহর সৃষ্টি কী অপরূপ সুন্দর! আর এই সৃষ্টির একে অপরকে কষ্ট দেয়, অমানবিক নির্যাতন করে। কী করে সম্ভব এসব?’ আমি হুজুরের মুখের দিকে তাকালাম। দেখি, চশমার ফাঁক গলে তার অশ্রু অঝোরে বেয়ে পড়ছে। বড় নিরীহ ও সাদামাটা সদালাপী ছিলেন তিনি। আমাকে বললেন, ‘এখানকার কিছু ছবি তুলে দেন। যেন বাসায় ফিরে এগুলো দেখি আর আল্লাহর কথা আরও বেশি স্মরণ হয়।’ হোটেলে ফেরার পথে সারাদিনের ক্লান্তি আমাকে চেপে বসল। আমি রীতিমতো ঘুমে ঢলে পড়লাম হুজুরের কোলে। হুজুর আমাকে তুললেন না। নিরিবিলি ঘুমাতে দিলেন। পথে কোথাও মসজিদ মিললে থামাতে বলা হলো ড্রাইভারকে। কিন্তু মেরিন ড্রাইভের দুই পাশের কোথাও মিলল না মসজিদের দেখা। অগত্যা পিচঢালা রাস্তায় নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামাজ শেষে হুজুর বললেন, ‘মাওলানা! ঘুম পূর্ণ হয়েছে? না হলে আবার ঘুমান। সমস্যা নেই।’ হুজুরের কথা শেষ হতে না হতেই ভাঙ্গার হুজুর কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘কতটা ঘুমিয়েছেন, জানেন? হুজুরের কোলে শুয়ে পড়লেন!’ কতটা দরদি, কতটা মায়াবী ছিলেন তিনি, সহজেই অনুমেয়।
পরদিন আমরা গেলাম হাটহাজারি মাদ্রাসায়। হুজুরকে দেখলাম, বাবুনগরী হুজুরের দরসে উন্মুখ হয়ে বসে আছেন। আমাকে বললেন, ‘মাওলানা! আপনি তরুণ মানুষ। না খেয়ে থাকতে কষ্ট হবে। খেয়ে নেন। আমি পরে খাব। আগে দরসটা শেষ করে আসি।’ হাটহাজারির বাংলাবাড়ির পরিচালক আমার বন্ধু ইশতিয়াক সিদ্দিকী তখন হাটহাজারির ছাত্র। আমি তার কামরায় গিয়ে তার আতিথ্য গ্রহণ করলাম। দরস শেষে হুজুরকে অনেকটা আবেগাপ্লুত দেখলাম। আমি হুজুরের হাত ধরে বললাম, ‘আপনি তো বড় মানুষ। আমি নিতান্ত অধম। আমার একটা কথার জবাব দেবেন?’ বললেন, ‘কী সেটা?’ বললাম, ‘আপনি এত সরল এবং স্মার্ট কেন? আমি তো জানি- যারা সরল হয়, তারা স্মার্ট হয় না। আবার যারা স্মার্ট হয়, তারা সরল হয় না।’ হুজুর আমার কথাটা এড়িয়ে গেলেন। বললেন, ‘মাওলানা! এটা আপনার আমার প্রতি সুধারণা। লিআন্না সাহিবাল বাইতি আদরা বিমা ফিহি।’ কিন্তু আমি তো জানি, হুজুরের মাঝে কতটা নববি গুণ ছিল! কতটা উদার, কতটা মানবিক, কতটা প্রেমময় ছিলেন তিনি!
গওহরডাঙ্গায় কোরবানির সময় ছাত্রদের ব্যতিক্রমী আয়োজন হলো। যার উদ্যোগ নেওয়া হলো, খাদেমুল ইসলাম বাংলাদেশের অধীনে। হুজুর যার বিভাগীয় জিম্মাদার ছিলেন। দাওরা-মিশকাত জামাতের ছাত্রদের অনুরোধে অন্যদের সঙ্গে আমাকেও বিচারক হিসেবে থাকতে হলো। অনুষ্ঠান শেষে আমাকে পাঁচ মিনিট কথা বলতে বলা হলো। আমি পুরো অনুষ্ঠানের ভুলচুক ধরিয়ে দিলাম। আলফাডাঙ্গা হুজুর ও রুপসা হুজুর আমাকে খুব বাহবা দিলেন। সেদিন সত্যিকারার্থে বুঝেছিলাম, তিনি কত বড় মানুষ! আমাকে বারবার বলেছিলেন, ‘মাওলানা! আপনার অনেক প্রতিভা আছে। আমরা আমাদের প্রতিভা কাজে লাগাতে পারিনি। আপনি আপনার প্রতিভা কাজে লাগান। ধরে রাখুন আজীবন।’ হুজুরের সেদিনের সেসব কথায় বেশ অনুপ্রাণিত হই। সে সময় আমার লেখা ‘কোরবানির তোহফা’ বইটি বের হয়। হুজুরকে পাঁচ কপি হাদিয়া দিই। তিনি অবর্ণনীয় খুশি হলেন। সেই থেকে তার প্রতি আরও শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল।
এর কিছুদিন বাদে বইমেলা উপলক্ষে আমার লেখা দাদারাজ্যে যাবার পথে ও সভ্যতার সাতকাহন নামে দুটি বই বের হয়। হুজুরকে হাদিয়া দিই। ‘দাদারাজ্যে যাবার পথে’ বই নিয়ে অনেক সমালোচনায় পড়ি। হুজুর এক সন্ধ্যায় আমাকে ডাকলেন। কথা বলতে বলতে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। ভরপুর নাশতা করালেন। এরপর বললেন, ‘মাওলানা! কাজের লোকের বড় অভাব। ওপরে তুলে দেওয়ার লোক তেমন নেই। কিন্তু নিচে টেনে নামানোর লোকের অভাব নেই। কে কী বলল, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আপনি আপনার কলম হকের পথে নিরবধি চালিয়ে যান। দেখবেন, সফলতা একদিন আপনার কদম ছোঁবেই।’ সেদিন আবেগাপ্লুত হয়ে হুজুরের হাত দুটো ধরে বললাম, ‘এভাবে কেউ কাউকে প্রেরণা জোগায় না। আপনি সত্যিই আমার প্রকৃত বন্ধু, উত্তম সঙ্গী। আপনি আমার জন্য দোয়া করুন; যেন দ্বীনের পথে আমরণ লিখে যেতে পারি।’ এর তিন মাস পর আমার নতুন বই বাজারে এলো। হুজুরকে পড়তে দিলাম। বললেন, ‘বাহ! নামটা তো অসাধারণ রেখেছেন- ধর্ম অধর্ম। আপনার সৃজনশীলতার জুড়ি নেই।’ হুজুরের সঙ্গে যখনই কথা বলতাম, কেমন একটা ভদ্রোচিত মার্জিত রূপ ধারণ করতেন। তার বলনে, চলনে, রুচি-অভিরুচিতে একটা রাজকীয় ভাব ছিল। ব্যক্তিত্বে বিরাজ করত অপূর্ব এক আভিজাত্য।
১৭ আগস্ট ২০২২ হুজুর হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিসসহ নানান রোগে জর্জরিত ছিলেন। তাকে ঢাকায় আনা হলো। মহাখালীর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হলো। কিন্তু হুজুরের হায়াত নামক ঘড়ির কাঁটা হয়তো ব্যতিব্যস্ত ছিল। পাঁচ ছেলে-মেয়ের জনক এই আভিজাত্যের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হাদিসবিশারদ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। একজন আলেমের মৃত্যু মানে আলমের মৃত্যু। তার মতো এমন দরদি লোকের সত্যিই বড় অভাব। তিনি এসেছিলেন, অনেক কিছু রেখে গেলেন। দিয়ে গেলেন আমাদের। কিন্তু আমরা তার জন্য কিছুই করতে পারিনি। শুধু রাব্বে কারিমের কাছে প্রার্থনা রইল, তিনি যেন তাঁর বান্দাকে প্রিয় থেকে প্রিয়তর করে নেন। তার শোকসন্তপ্ত পরিবার ও স্বজনকে সবরে জামিল দান করেন। আমাদেরকে তার উন্নত আদর্শ, আভিজাত্য, রুচি-অভিরুচি ধারণ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর মর্জিমতো জীবন পরিচালিত করার তৌফিক দান করেন। আমিন।