ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কোরআনের গল্প

রাখে আল্লাহ মারে কে!

আবদুল্লাহ সরদার
রাখে আল্লাহ মারে কে!

এক ইহুদি বাদশাহ। নাম তার যারআ বিন তিব্বান। প্রচণ্ড ক্ষমতা তার। রাজদরবার বিশিষ্ট মানুষে পূর্ণ। একজন জাদুকরও ছিল তার। সময়ে-অসময়ে যে তার বিভিন্ন কাজে সাহায্য করত। সময়ের পরিক্রমায় একদিন বুড়িয়ে যায় জাদুকর। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। ক্ষীণ হয়ে আসে দৃষ্টি। মৃত্যুর ছায়া তাড়িয়ে ফেরে সবসময়। বাদশাহকে তাই একদিন জাদুকর বলল, ‘বয়স তো হলো! কয়দিন আর বাঁচব। একটা বালক এনে দাও তো! জীবনের সঞ্চিত সব শিক্ষা তাকে দিয়ে যাই।’

বাদশাহ একজন বালক নির্বাচন করে পাঠাল। জাদুকর মহাআগ্রহে তাকে জাদু শেখাতে লাগল। চলতি পথে ছেলেটি একদিন এক সন্ন্যাসীকে দেখতে পেল। তার কাছে গেল। মোহমুগ্ধের মতো তার কথা শুনল। অনেক সময় পেরিয়ে গেল। ছেলেটি ভুলে গেল জাদুকরের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা। তাই রোজই মার খেতে হলো তাকে। এ কথা সন্ন্যাসীকে বলল। তিনি অসম্ভব সুন্দর একটি উপায় বলে দিলেন, জাদুকর জিজ্ঞেস করলে বলবে- ‘পরিবারে কাজ ছিল। আসতে দেয়নি।’ আর পরিবার জিজ্ঞেস করলে বলবে- ‘জাদুকর আটকে রেখেছিল।’

পথিমধ্যে একদিন সে এক বিরাট দৈত্যকায় হিংস্র পশু দেখতে পেল। মানুষের পথ আটকে রেখেছে সে। ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন এগোচ্ছে না কিছুতেই। ছেলেটি মনে মনে বলল, এটাই সুযোগ। আজ পরীক্ষা হয়ে যাক। আল্লাহর কাছে অধিকতর প্রিয় কে? জাদুকর না সন্ন্যাসী! তাই সে একটি ছোট্ট পাথরের টুকরো তুলে নিল। মনে মনে বলল, আল্লাহ! এই সন্ন্যাসী যদি তোমার কাছে প্রিয় হয়ে থাকে, তাহলে একে ধ্বংস করো। বলেই ছুড়ল পাথরকণা। লাগার সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল সেই প্রাণীটি।

ছেলেটি এ ঘটনা সন্ন্যাসীকে জানাল। তখন সন্ন্যাসী বলল, ‘তুমি আমার চেয়ে অধিক শ্রেষ্ঠ! খুব দ্রুতই পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। মনে রাখবে, আমার কথা যেন বলে দিও না।’ এরপর থেকে ছেলেটির মাধ্যমে অনেক অন্ধ, কুষ্ঠরোগী ভালো হতে থাকল। দিকে দিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। বাদশাহর রাজদরবারের এক সদস্য ছিল অন্ধ। সে যখন এ খবর পেল, হাদিয়া বোঝাই করে ছুটে এলো বালকের কাছে। বলল, ‘আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দাও। এসব তোমার হয়ে যাবে।’ বালক বলল, ‘আসলে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ার আমি কেউ নই। সব ক্ষমতাই আল্লাহর। তুমি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো, তবে দৃষ্টি ফিরে পাবে।’ তখনই লোকটি ঈমানের আলোয় আলোকিত হলো। দূর হলো তার চোখের সব আঁধার।

রাজদরবারে সে যখন সুস্থ চোখে উপস্থিত হলো, বাদশাহর চোখ চড়কগাছ- ‘একি! তোমার চোখ ভালো করল কে?’ লোকটি নির্ভয়ে জবাব দিল, ‘আমার রব’। বাদশা বলল, ‘আমি’? লোকটি বলল, ‘না’। বাদশা ক্রোধে ফেটে পড়ল, ‘আমি ছাড়া তোমার আরও রব আছে।’ লোকটি বলল, ‘আমার এবং আপনার রব একজনই, তিনি হলেন আল্লাহ।’ বাদশাহ লোকটিকে শাস্তি দিতে থাকল। এক পর্যায়ে সে বালকটির কথা বলেই ফেলল। বাদশাহ আদেশ জারি করল, ‘অতিসত্বর তাকে উপস্থিত করো।’

আদেশ পেয়ে বালককে হাজির করা হলো। তার সামনেই সেই রাজসদস্য আর সন্ন্যাসীর মাথা চিড়ে ফেলা হলো। কিন্তু বালকের ঈমানে চিড় ধরল না। আগের মতো প্রশ্ন করল বাদশাহ। অকুণ্ঠচিত্তে জবাব দিল ছেলেটি। রব হিসেবে একজনকেই মানে, তিনি আল্লাহ। বাদশাহ তখন ছেলেটিকে কিছু লোকের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল। বলল, ‘একে নিয়ে পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় যাবে। তারপরও যদি আমাকে রব না মানে, তখন ফেলে দেবে।’ কথা মতো পাহাড়ের চূড়ায় হাজির হলো লোকগুলো। ছেলেটি দোয়া করল মনে মনে, ‘হে আল্লাহ! আপনি ইচ্ছে মতো ফয়সালা করেন।’ তখনই পাহাড়টি কেঁপে উঠল। লোকগুলো একে একে পড়ে গেল নিচে।

ছেলেটি রাজদরবারে ফিরে এলো। বাদশাহ এবার আরেকটি দলের সঙ্গে তাকে পাঠাল। বলে দিল, ‘মাঝ সমুদ্রে নিয়ে ডুবিয়ে মারবে একে, যদি তার ধর্ম-বিশ্বাস থেকে ফিরে না আসে।’ কিন্তু তাদের অবস্থাও একই হলো। ডুবে মরল তারা। এবারও ফিরে এলো ছেলেটি। বাদশাহকে সে নিজেই বলল, ‘আমার মৃত্যুরহস্য তোমাকে বলে দিই। একটি মাঠে সব মানুষকে একত্রিত করবে। তারপর শূলে চড়াবে আমাকে। আমার তূণীর থেকে একটি তির নিয়ে এ বালকের প্রতিপালক আল্লাহর নামে বলে তির ছুড়বে।’ তাই করল বাদশাহ।

ছেলেটি মারা গেল। কিন্তু উপস্থিত সবাই সমকণ্ঠে গেয়ে উঠল তৌহিদের অমীয় বাণী। বাদশাহ হতবাক। সে যার আশঙ্কা করছিল, তাণ্ডই ঘটল শেষমেশ। এবার সে অনেকগুলো গর্ত করল। আগুন জ্বালালো সেখানে। তারপর মানুষগুলোকে ছুড়ে মারল সেই তপ্ত আগুনের গর্তে। (তাফসির ইবনে কাসির : ৪-৫৯৯/৬০০, কাসাসুল কোরআন : ৩৯৭-৩৯৯)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত