প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২
রোকন অর্থ স্তম্ভ, খুঁটি, ভিত্তিমূল। প্রতিটি অস্তিত্বশীল সত্তারই ভিত্তি স্থাপিত হয় তার স্তম্ভের ওপর। ঠিক তেমনি ঈমানের তাবৎ অস্তিত্বও দাঁড়িয়ে আছে কিছু রোকন বা স্তম্ভের ওপর। এসব রোকন ছাড়া ঈমানের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। ইসলামি জ্ঞানকলায় ঈমানের স্বীকৃত রোকন ছয়টি। সে ছয়টি বিষয়ের ওপর যথাযথ আস্থা, ভক্তি ও বিশ্বাসের সমন্বয় করা ঈমানের পূর্বশর্ত। এ ছয়টি বিষয়ে বিশ্বাসের আবশ্যিকতা বিবৃত হয়েছে কোরআন-সুন্নাহর অসংখ্য বর্ণনায়। যেমন- হাদিসে জিবরাইলের দ্যর্থহীন ভাষ্য, রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ঈমান কী?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘ঈমান হলো, তুমি বিশ্বাস স্থাপন করবে আল্লাহর ওপর, তাঁর ফেরেশতাদের ওপর এবং তাঁর প্রেরিত আসমানি কিতাবগুলোর ওপর, রাসুলদের ওপর এবং পরকালের ওপর; এমনিভাবে বিশ্বাস স্থাপন করবে তাকদির তথা ভালো-মন্দের নির্ধারক আল্লাহ মর্মে।’ (বোখারি : ১/২৭)।
আল্লাহর ওপর বিশ্বাস
এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যে, আল্লাহতায়ালা এক ও অদ্বিতীয়; তাঁর একত্বে অন্য কারও অংশীদারিত্ব নেই। তিনিই রব তথা প্রতিপালক; তিনি ছাড়া কোনো প্রতিপালক নেই। তিনি একমাত্র উপাস্য, মাবুদ; তিনি ছাড়া অন্য কেউ উপাসনার যোগ্য নেই। সার্বভৌম ক্ষমতা ও শক্তির একচ্ছত্র উৎস একমাত্র তিনি, কেউ তাঁর সমতুল্য নেই। এমনিভাবে সব ধরনের মর্মগত বিকৃতি ও সৃষ্টিজীবের সঙ্গে সাদৃশ্যকরণ ছাড়া, কোরআন-সুন্নাহে বিবৃত আল্লাহর সব গুণবাচক নাম ও গুণাবলির ওপর নির্ভেজাল বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ঈমান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলুন, তিনি এক। তিনি অমুখাপেক্ষী। তিনি জন্মগ্রহণ করেননি, তার থেকেও কেউ জন্ম নেয়নি। তার সমকক্ষও কেউ নেই।’ (সুরা ইখলাস : ১-৪)।
ফেরেশতাদের ওপর বিশ্বাস
ঈমানের দ্বিতীয় রোকন হলো, ফেরেশতাদের ওপর বিশ্বাস করা। অর্থাৎ এ বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা যে, ফেরেশতারা আল্লাহর সৃষ্টি; তাদেরকে নুর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, তাদের অস্তিত্ব সত্য, তারা আল্লাহর নির্দেশনাবলিকে লঙ্ঘন করেন না, তাঁর কোনো হুকুমের অবাধ্য হন না, আল্লাহর দেওয়া সব দায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন করেন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর ওপর, ফেরেশতাদের ওপর, কিতাবগুলোর ওপর, রাসুলের ওপর।’ (সুরা বাকারা : ২৮৫)।
আসমানি কিতাবের ওপর ঈমান
নবী-রাসুলদের কাছে প্রেরিত জ্ঞাত-অজ্ঞাত সব আসমানি সহিফা বা ঐশীগ্রন্থের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ আপনার ওপর সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছেন; যা আগের (কিতাব ও রাসুলের) সত্যয়নকারী এবং তিনিই তাওরাত-যাবুর নাজিল করেছেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩)। আমাদের পরিজ্ঞাত কিতাবগুলো হলো, মুসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ তাওরাত, ঈসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ ইঞ্জিল, দাউদ (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ যাবুর, ইবরাহিম (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ সাহিফায়ে ইবরাহিম এবং প্রিয়নবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ চিরঞ্জীব ঐশীগ্রন্থ আল কোরআন। এর মাঝে শুধু কোরআন ছাড়া বাকি সব কিতাব বিধানগতভাবে রহিত হয়ে গেছে।
নবী-রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস
মানবজাতির জন্য প্রেরিত সব নবী-রাসুলের ওপর বিশ্বাস ও সত্যায়ন ঈমানের অন্যতম রোকন। তাদের সঠিক সংখ্যা একমাত্র আল্লাহতায়ালাই জানেন। কোরআনে ২৫ জন নবী-রাসুলের নাম উল্লেখ রয়েছে। এর বাইরে অসংখ্য নবী-রাসুল রয়েছেন, যাদের সবার ওপর সাধারণভাবে বিশ্বাস রাখতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসুলের, তাঁর রাসুলের কাছে তিনি অবতীর্ণ করেছেন সেই কিতাবের এবং আগে নাজিলকৃত কিতাবের ওপর ঈমান আন। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ও তাঁর ফেরেশতাদের, তাঁর কিতাবগুলোকে, তাঁর রাসুলদের এবং শেষ দিবসকে অস্বীকার করে, সে সীমাহীন পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।’ (সুরা নিসা : ১৩৬)।
পরকালে বিশ্বাস
বস্তুবাদী জীবন-দর্শন শুধু ইহ-জাগতিকতার স্বীকৃতি দেয়। তাদের দার্শনিকতা ও বিজ্ঞানবাদ সত্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় হিসেবে বিবেচনা করে পঞ্চ ইন্দ্রিয়জ পরিসীমা ও অভিজ্ঞতাবাদের আওতায়; যা চূড়ান্ত ত্রুটিপূর্ণ। পক্ষান্তরে ঈমানের ধারক একজন মোমিন পঞ্চ ইন্দ্রিয়জ বিষয়ের সীমানা ও অভিজ্ঞতাবাদকে অস্বীকার করে না। তবে এর সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সে স্বজ্ঞা নামক এক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দার্শনিক চোখে স্বীকৃতি দেয় ওহির সত্যতা ও ধ্রুবতাকে। তাই ওহির মাধ্যমে প্রাপ্ত পরকালীন জীবনের উপস্থিতি তার কাছে চির ধ্রুব ও প্রশ্নহীন সত্য। এর ওপর বিশ্বাস রাখা মোমিন জীবনের অন্যতম ব্রত।
তাকদিরের ওপর বিশ্বাস
এ কথা বিশ্বাস করা যে, যাবতীয় ভাগ্য, কল্যাণ-অকল্যাণ সবকিছুই আল্লাহর ক্ষমতাধীন। ভালো-মন্দ সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। এমনিভাবে মানুষের কৃত উত্তম আমল এবং অনুত্তম আমল উভয়টি আল্লাহর হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। তবে প্রথমটি আল্লাহর সন্তুষ্টি চিত্তে এবং দ্বিতীয়টি তাঁর অসন্তুষ্টিতে হয়। এর পেছনে আবার ক্রিয়াশীল থাকে প্রধানত বান্দার নিজ কর্ম ইচ্ছার স্বাধীনতা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, আর তাদের তাকদিরকে সুনির্ধারিত করে দিয়েছেন।’ (সুরা ফোরকান : ২)।