সৎকর্ম সম্পাদন
অন্যায়-অনাচার করে কোনো ব্যক্তি সফল হতে পারে না। দুর্নীতি ও কদাচারের মাধ্যমে সাময়িকভাবে কোনো ব্যক্তি সুখী হয়ে গেলেও এর পরিণাম শুভ হয় না। তাই সফল হওয়ার অন্যতম উপায় হলো, সৎকর্ম অবলম্বন করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা রুকুণ্ডসেজদা কর, তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর ও সৎকাজ সম্পাদন কর; যাতে সফলকাম হতে পার।’ (সুরা হজ : ৭৭)। এ সৎকর্মের ধারাবাহিকতায় রয়েছে ঈমান আনয়ন, নম্রভাবে নামাজ আদায়, অর্থহীন কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা, জাকাত দান করা, রোজা রাখা, যৌনাঙ্গকে বেহায়াপনামুক্ত রাখা, আমানতের খেয়ানত না করা ও অঙ্গীকার পূরণ করা। পবিত্র কোরআনে এসব সৎকর্ম সম্পাদনকারীকে সফল বলে আখ্যায়িত করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনরা সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র; যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত, যারা জাকাত দান করে থাকে এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। এরপর কেউ এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমা লঙ্ঘনকারী হবে। যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে। যারা তাদের নামাজের খবর রাখে। তারাই উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা শীতল ছায়াময় উদ্যানের উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা তাতে চিরকাল থাকবে।’ (সুরা মোমিনুন : ০১-১১)। হাদিসেও নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতকে সাফল্য লাভের উপায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.) বলেন, এক নজদবাসী রাসুল (সা.)-এর কাছে এলো। তার মাথার চুল ছিল এলোমেলো। আমরা তার কথার মৃদু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম; কিন্তু সে কি বলছিল, তা বুঝতে পারছিলাম না। এভাবে সে কাছে এসে ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘দিনরাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।’ সে বলল, ‘আমার ওপর এ ছাড়া আরও নামাজ আছে?’ তিনি বললেন, ‘না, তবে নফল আদায় করতে পার।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আর রমজানের রোজা।’ সে বলল, ‘আমার ওপর এ ছাড়া আরও রোজা আছে?’ তিনি বললেন, ‘না, তবে নফল আদায় করতে পার।’ বর্ণনাকারী বলেন, রাসুল (সা.) তার কাছে জাকাতের কথা বললেন। সে বলল, ‘আমার ওপর এ ছাড়া আরও আছে?’ তিনি বললেন, ‘না, তবে নফল হিসেবে দিতে পার।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘লোকটি এ বলে চলে গেল- আল্লাহর শপথ! আমি এর চেয়ে অধিকও করব না এবং কমও করব না।’ তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘সে সফল হবে, যদি সত্য বলে থাকে।’ (বোখারি : ৪৬)।
ধৈর্যধারণ
দুঃখ-কষ্ট, আপদ-বিপদ, বালা-মসিবত ও দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। জীবন যতদিন, দুঃখণ্ডকষ্ট, অভাব-অনটন ও বালা-মসিবত ততদিন। তাই বলে ভগ্নহৃদয় হলে চলবে না। হতাশ হলে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। দুঃখ-কষ্টের সময় ধৈর্যহারা না হয়ে দৃঢ়চিত্তের সঙ্গে মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। সমস্যাসঙ্কুল অবস্থায় ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে পথ চলতে হবে। প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ধৈর্যহারা হলে সফল হওয়া যাবে না। প্রবাদ আছে, ‘ধৈর্য সফলতার চাবিকাঠি।’ ধৈর্যধারণ সফলতা লাভ করার অন্যতম উপায়। তাই ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! ধৈর্যধারণ কর এবং মোকাবিলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক; যাতে তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সফল হতে পার।’ (সুরা আলে ইমরান : ২০০)। আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা, অটল অবিচল থাকা ও ধৈর্যধারণ করাও সাফল্য লাভের অন্যতম উপায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ কর এবং তাঁর পথে জিহাদ কর; যাতে সফলকাম হতে পার।’ (সুরা মায়িদা : ৩৫)।
মদ-জুয়া ও প্রতিমা বর্জন
মস্তিষ্ক আল্লাহর দেওয়া এক অনন্য নেয়ামত। এ নেয়ামতের মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ পরখ করতে পারে। মস্তিষ্কের মধ্যে ভালো-মন্দ পরখ করার গুণ রয়েছে। কিন্তু মদ্যপান অনেক সময় মস্তিষ্কের এ গুণ কেড়ে নেয়। মদ্যপানকে ইসলামে হারাম করা হয়েছে। অনুরূপ জুয়া মানুষকে সর্বহারা করে। জুয়াখেলায় অভ্যস্ত ব্যক্তি জুয়া খেলতে গিয়ে অনেক সময় সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শরিয়তে জুয়া খেলাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিমা ও ভাগ্য-নির্ধারক শরগুলো কখনও ভাগ্য নির্ধারণ করার সক্ষমতা রাখে না। মূর্তি ও প্রতিমার কোনো শক্তি নেই, তেমনি ভাগ্যনির্ধারক শরের কোনো সক্ষমতা নেই। তাই মদ্যপান, জুয়া খেলা ও প্রতিমাপূজা থেকে সর্বাবস্থায় বিরত থাকতে হবে। কেননা, এ কাজগুলো সাফল্য লাভের পথে অন্তরায়। মদ, জুয়া ও প্রতিমাকে অপবিত্র ঘোষণা করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! মদণ্ডজুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্যনির্ধারক শরগুলো শয়তানের অপবিত্র কাজ ছাড়া কিছুই নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক। যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা মায়িদা : ৯০)।
আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ
আল্লাহতায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন। অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন। প্রতিমুহূর্তে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অগণিত নেয়ামতে ডুবিয়ে রেখেছেন। তাই আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ রাখতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি চিন্তা করে, আল্লাহতায়ালা আমাকে সব সময় বাঁচিয়ে রাখছেন, তাহলে তার দ্বারা অন্যায় ও অপরাধ হতে পারে না। যদি কোনো ব্যক্তি চিন্তা করে, আল্লাহতায়ালা আমাকে চোখ দিয়েছেন, তাহলে তার চোখ দ্বারা অপাত্রে দৃষ্টিপাতের পাপ হতে পারে না। যদি কেউ চিন্তা করে, আল্লাহ আমাকে হাত দিয়েছেন, তাহলে এর হাত দ্বারা অন্যায় ও অপরাধমূলক কোনো কাজ হতে পারে না। যদি কেউ ভাবে, আল্লাহ আমাকে পা দিয়েছেন, তাহলে এর পা দ্বারা গোনাহের কাজ হতে পারে না। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর নেয়ামতরাজিকে স্মরণ করবে, সে অনেক অন্যায়-অপরাধ থেকে বেঁচে যাবে। আর অন্যায়-অপরাধ থেকে বিরত থাকা সাফল্য লাভের অনুকূল। তাই আল্লাহতায়ালা তাঁর নেয়ামতরাজিকে স্মরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর নেয়ামতগুলো স্মরণ কর; যাতে তোমাদের সাফল্য লাভ হয়।’ (সুরা আরাফ : ৬৯)।
তওবা করা
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অপরাধ হয়েই যায়; কিন্তু তার ওপর অটল-অবিচল থাকা সাফল্য লাভের অন্তরায়। কোনো অপরাধ হলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং কায়মনোবাক্যে তওবা করতে হবে। অপরাধ হওয়ার পর আল্লাহর সঙ্গে এ মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে, হে আল্লাহ! আমার দ্বারা এই গোনাহ হয়ে গেছে। আমি মস্ত বড় অপরাধ করে ফেলেছি। আমি আপনার দরবারে লজ্জিত ও অনুতপ্ত। এই গোনাহ আমি আর কখনও করব না। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। গোনাহ হয়ে যাওয়ার পর কোনো ব্যক্তি যদি এভাবে আল্লাহর কাছে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে আল্লাহতায়ালা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেবেন। তাকে দোজখের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দেবেন। এটাই তার মহাসাফল্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনরা, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর; যাতে সফলকাম হতে পার।’ (সুরা নুর : ৩১)।
পরিশুদ্ধ হওয়া
সমাজে কিছু মানুষ অন্যায়-অনাচার, দুর্নীতি ও কদাচারের মাধ্যমে জীবন কলুষিত করে, আবার অনেকে সৎকর্ম সম্পাদন করার মাধ্যমে জীবন সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। এ দুই শ্রেণির মানুষের মধ্যে সফল তারাই, যারা জীবনকে অন্যায়-অনাচার থেকে দূরে রেখে আপন আপন আত্মা পরিশুদ্ধ করে। আত্মার পরিশুদ্ধি সাফল্য লাভের অন্যতম উপায়। কেননা, অন্যায়-অনাচার ও অসদুপায় সাফল্য লাভের পথে অন্তরায়। যদি কোনো ব্যক্তি নিজের আত্মাকে অন্যায়-অপরাধ থেকে পরিশুদ্ধ রাখতে পারে, তাহলে ইহ-পরকালে সে সফল হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয় এবং তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করে, আর নামাজ আদায় করে।’ (সুরা আলা : ১৪-১৫)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সে-ই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।’ (সুরা শামস : ১৪-১৫)।