দূরের পাহাড়। আকাশ ছুঁয়ে যায় যেন। একটি গুহা সেই পাহাড়ের নিচে। তার মধ্যে একজন ধ্যানমগ্ন মানুষ। লুটিয়ে পড়েছে সেজদায়। রোজকার দৃশ্য এটি। জীবন-সংসারের সব ঝামেলা চুকিয়ে এক আল্লাহর ইবাদতে আত্মবিলীন মানুষটা। কারুন তার নাম। সম্পর্কে নবী মুসা (আ.)-এর চাচাতো ভাই। কারুনের এমন ইবাদত দেখে ইবলিস জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়। ফন্দি আঁটে মনে মনে, কীভাবে দিশাহীন করা যায় তাকে। একদিন শয়তান মানুষের বেশে হাজির হলো তার কাছে। বলল, ‘আপনার সঙ্গে ইবাদত করতে চাই আমিও।’ কারুন ঠাওরাল না কিছুই। সহজ গলায় বলল, ‘অবশ্যই।’ শুরু হলো যৌথ ইবাদত। দিনরাত এক করে আল্লাহর সামনে নত হয়ে থাকে দু’জন। খানিকটা প্রতিযোগিতা হয় যেন। কিন্তু এগিয়ে গেল ইবলিস। কারুন অবাক হলো বেশ। ধীরে ধীরে ইবলিসের অনুগত হয়ে পড়ল। সম্মানের চোখে দেখতে লাগল তাকে। নিজের সফলতায় ইবলিস মুগ্ধ হলো। তাকে বলল, ‘কওমের কোনো কাজেই অংশগ্রহণ করা যাবে না। না ঈদে, না জামাতে। তাহলে আরও ইবাদত করতে পারব।’ কারুন সায় দিল।
ক’দিন কাটল এভাবে। গুহা থেকে বেরুল না তারা। বনি ইসরাইল খাবার পৌঁছে দিল গুহায়। একদিন ইবলিস বলল, ‘আমরা কওমের ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছি। কী দরকার আছে! নিজেদের খাবার নিজেরাই উপার্জন করব।’ ঠিক হলো, সপ্তাহের একদিন উপার্জনে বেরুবে তারা। কারুন ইবলিসের এমন সুগঠিত মতামত দেখে অবাক হলো। শ্রদ্ধা বেড়ে গেল তার প্রতি। মনে মনে গুরু মানতে থাকল তাকে। দিন কয়েক পেরুতেই নতুন আবদার, ‘এবার একদিন কাজ করব, একদিন ইবাদত করব।’ উস্তাদের কথা ফেলতে নেই। এ পর্ব আরম্ভ হতেই কেটে পড়ল ইবলিস। ততদিনে কারুনের হৃদয় সম্পদের লিপ্সায় পূর্ণ। ইবাদতের কথা ভুলে গেছে সে। দিন কাটে সম্পদ উপার্জনে। সফলতাও ধরা দেয় তার হাতে।
কারুন মিশরের সবচেয়ে বড় ধনী হয়ে ওঠে। সম্পদের পরিমাণ এত বেশি হয় যে, ৭০টি খচ্চরই লাগত তার চাবি বহন করতে। দম্ভভরে হাঁটে সে। মাটিতে পা পড়ে না যেন। চারপাশটা সবসময় পূর্ণ থাকে সেবক-সেবীকাদের দিয়ে। কী বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে মানুষ তার সম্পদ দেখে, ভাবতেই আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় হৃদয়ে। সুখশান্তির এ অপূর্ব সময়ে মুসা (আ.) যেন নেমে এলেন আপদ হিসেবে। দরদমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘কারুন! তোমার এই অঢেল সম্পদ তো আল্লাহরই দান। কত দরিদ্র আছে, খেতে পাচ্ছে না। পরার কাপড় মিলছে না। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। এদের প্রতি দয়া করার আদেশ দেওয়া হয়েছে তোমাকে। সম্পদের জাকাত দাও তুমি।’
কারুন চুপচাপ শুনলো। তার মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। ভ্রূ কুচকে আছে। হুট করেই চিৎকার জুড়ে দিল। বলল, ‘এ সম্পদ আল্লাহ দিয়েছে! নিজের শ্রম আর বুদ্ধির জোরেই হাসিল করেছি।’ কণ্ঠে অহংবোধ তার। ঔদ্ধত্য ঝরে পড়ছে চোখ থেকে। এরপর বলল, ‘আচ্ছা, বলো! কত জাকাত দিতে হবে?’ মুসা (আ.) বললেন, ‘হাজারে এক দিরহাম ও দিনার।’ এটা অনেক মনে হলো কারুনের কাছে। ফিরিয়ে দিল মুসা (আ.)-কে। ভাবল, মুসা যেন দ্বিতীয়বার জাকাতের কথা বলতে না আসে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। কওমের বড় বড় ব্যবসায়ী এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের ডাকল। জমজমাট মজমা বসল। সবাইকে উদ্দেশ করে কারুন বলল, ‘মুসাকে না ঠেকালে তোমাদের কষ্টার্জিত সম্পদ সব জলে যাবে। লুটেপুটে খাবে ফকির-মিসকিন। একটা বিহিত করতেই হয়।’ সায় দিল সবাই।
ডাকা হলো এক দেহপসারিণীকে। তার হাতে এক হাজার দিনার ও দিরহাম ধরিয়ে দিল কারুন। একটি কাজ করতে হবে তাকে। ওয়াজের ময়দানে শুধু বলতে হবে, মুসা তার সঙ্গে জেনা করেছে। রাজি হলো সে নারী। সপ্তাহের একদিন মুসা (আ.) বয়ান করতেন। দিতেন শরয়ি দিকনির্দেশনা। সে সময় এলো। মুসা (আ.) দাঁড়ালেন। বলতে শুরু করলেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা জেনা-ব্যভিচার থেকে বেঁচে থাকো।’ মাঝ থেকে কারুন হাত তুলল। খুশি খুশি তার মুখ। বলল, ‘যদি কেউ জেনা করে, তাহলে শাস্তি কী হবে তার?’ মুসা (আ.) বললেন, ‘পাথর মেরে হত্যা করা হবে তাকে।’ মওকা মিলল যেন। কারুন বলল, ‘যদি আপনি করেন?’ মুসা (আ.) শান্ত গলায় বললেন, ‘একই শাস্তি।’ কারুন এবার বলল, ‘আপনি তো জেনা করেছেন। আবার বড় বড় উপদেশ দিচ্ছেন!’ মুসা (আ.) প্রমাণ চাইলেন।
সে নারীর ডাক পড়ল এবার। তার দিকে ইশারা করে কারুন বলল, ‘এর সঙ্গে জেনা করেছেন আপনি। এ নারীই তার সাক্ষী।’ মুসা (আ.)-এর মুখ লাল হয়ে গেল। ক্ষোভে কাঁপতে লাগলেন। সেই নারীকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আল্লাহকে সাক্ষী রেখে সত্য বলো।’ কেঁদে উঠল নারীটি। আঁচলের নিচ থেকে দিরহামণ্ডদিনারের পুঁটলি বের করে আনল। বলল, ‘কারুনই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে এসব বলতে।’ মুসা (আ.) দোয়া করলেন, মাটিকে যেন তার অনুগত করে দেওয়া হয়। আল্লাহর হুকুমে মাটি তার অনুগত হলো। তারপর সম্প্রদায়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা আমাকে ফেরাউনের কাছে যেমনি পাঠিয়েছেন, তেমনি পাঠিয়েছেন কারুনের কাছে। তোমাদের যার ইচ্ছে কারুনের দলে ভিড়তে পার কিংবা আমার দলে।’
সবাই মুসা (আ.)-এর পাশে এসে দাঁড়াল। রয়ে গেল দু’জন আর কারুন। মুসা (আ.) আদেশ করলেন মাটিকে, ‘পাকড়াও করো এদের।’ পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত দেবে গেল। কারুন অনুনয় শুরু করল। ক্ষমা চাইল বারবার। মুসা (আ.) তার সিদ্ধান্তে অটল। ফের একই কথা বললেন। হাঁটু সমেত মাটির নিচে ঢুকে পড়ল তারা। ধীরে ধীরে তাদের গলা পর্যন্ত গিলে নিল মাটি। আবার বললেন, ‘পাকড়াও!’ এরপর নিমিষেই তাদের গোটা দেহ উধাও হয়ে গেল। (সুরা কাসাস : ৭৬-৭৭, কিতাবু মাকায়িদিশ শাইতান : ৭৮)।