প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৯ অক্টোবর, ২০২০
যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, হত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতন ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। যেসব কারণে এসব হয় সেগুলো ত্রিবিধ; কিছু কারণ নির্যাতনকারীকে নির্যাতনে উদ্বুদ্ধ করে এবং কিছু কারণ নির্যাতিতাকে নির্যাতিত হতে বাধ্য করে। এছাড়া রয়েছে কিছু সামাজিক কারণ, যেগুলো এই অপরাধগুলো সংঘটনে সাহায্য করে। ফলে তা মহামারি আকার ধারণ করে ও সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এসবের কোনোটি মুখ্য, কোনোটি গৌণ। এ কারণগুলোর কোনো একটি বা দুটি এককভাবে দায়ী নয়, তবে প্রত্যেকটিই প্রভাবক বা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। সুতরাং কোনো একটি বা কয়েকটি কারণকে সুনির্দিষ্ট করে দায়ী করা ঠিক নয়। তাই সমস্যা সমাধানে সামগ্রিক দিক বিবেচনা করতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতনকারী সৃষ্টির কারণ
সুশিক্ষার অভাব তথা ধর্মীয় শিক্ষা না থাকা, অধ্যাত্মিক শিক্ষা না থাকা, নৈতিক শিক্ষা না থাকা। বস্তুবাদী দর্শন, বস্তুবাদী শিক্ষা ও বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থা। ব্যক্তিত্বহীনতা বা নেতিবাচক ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদার অভাব। পারিবারিক বন্ধনের অভাব, অভিভাবকের ঔদাসীন্য, পারিবারিক বন্ধন ও শাসন শিথিল হওয়া। অসৎসঙ্গ গ্রহণ, মাদকাসক্তি, পর্নোগাফি আসক্তি। ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার, অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব। অবৈধ প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিকৃত রুচি ও মানসিক বিকার। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও মূল্যবোধের অভাব। ধর্মীয় মূল্যবোধ না থাকা, হারাম-হালাল ও পবিত্রতা-অপবিত্রতার অনুভব না থাকা এবং ধর্মীয় অনুশাসন না মানা।
নারী ও শিশু নির্যাতিত হওয়ার কারণ
সুশিক্ষার অভাব তথা ধর্মীয় শিক্ষা না থাকা, অধ্যাত্মিক শিক্ষা না থাকা, নৈতিক শিক্ষা না থাকা। ব্যক্তিত্ব-জ্ঞান না থাকা, আত্মসম্মান বোধের অভাব ও দুর্বল মানসিক গঠন বা হীনমন্যতা। আত্মরক্ষা বিষয়ে অজ্ঞতা বা অসচেতনতা। পারিবারিক বন্ধনের দুর্বলতা, অভিভাবকের উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন ও শাসন শিথিল হওয়া। অসৎসঙ্গ পরিগ্রহণ করা, মাদকাসক্তি। অর্থ-সম্পদের মোহ, রঙিন জীবনের হাতছানির প্রতি আকর্ষণ। পর্নোগাফি আসক্তি, ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার, অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও মূল্যবোধের অভাব। ধর্মীয় মূল্যবোধ না থাকা, হারাম-হালাল ও পবিত্রতা-অপবিত্রতার অনুভব না থাকা এবং ধর্মীয় অনুশাসন না মানা।
নারী ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধির সামাজিক কারণ
বস্তুবাদী দর্শন, ধর্মহীন শিক্ষা ও ভোগবাদী সমাজব্যবস্থা। কিশোর গ্যাং, যৌতুক, বিলম্বে বিবাহ। মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি। বেকারত্ব, মা-বাবা বা অভিভাবকের অনৈতিক সম্পর্ক বা আচরণ ও অসামাজিক কর্মকা-। অবৈধ অর্থ-সম্পদ। ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার, অপসংস্কৃতির প্রচার-প্রসার। রাজনৈতিক অনৈতিক সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা। স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অসাধুতা।
প্রশাসনিক দুর্নীতি ও প্রশাসনের রাজনৈতিক ব্যবহার : রাজনৈতিক নিয়োগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার, রাজনৈতিক পরিচয়ে পদায়ন, পদোন্নতি ও সুবিধা প্রদান। বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি ও বিচার বিভাগের রাজনৈতিক ব্যবহার।
বিচার ব্যবস্থার প্রতিকূলতা : যথা নারীবান্ধব আদালত না থাকা, নারীবান্ধব তদন্ত না থাকা, নারীবান্ধব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যবস্থা-পদ্ধতি না থাকা, নারীবান্ধব আইনজীবী না থাকা, নারীবান্ধব বিচার ব্যবস্থা না থাকা, বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারকার্যে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ, অপরাধীকে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা করা।
নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে যা যা করতে হবে
সুশিক্ষার সুব্যবস্থা : ধর্মীয় শিক্ষা, অর্থাৎ জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা; জীবন ও মৃত্যুর রহস্য, কেয়ামত আখেরাত পুনরুত্থান ও শেষ বিচার এবং শেষ পরিণতি জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান।
অধ্যাত্মিক শিক্ষা : তাকওয়া, তাজকিয়া ও ইহসানবিষয়ক তত্ত্ব-জ্ঞান। নৈতিক শিক্ষা, মানে সততা, সৎচিন্তা, সদাচার, শুদ্ধাচার ইত্যাদি অনুশীলন ও কর্মফলের ধারণা। বস্তুবাদী দর্শন, বস্তুবাদী শিক্ষা ও বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন করে সাম্য, সুবিচার, ন্যায়-ইনসাফ ও তাকওয়াভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং তৌহিদবাদ ও আখেরাতমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। ব্যক্তিত্বের বিকাশ, সুকুমারবৃত্তি, ইতিবাচক ব্যক্তিত্ব, সফল জীবন ও জীবনের সফলতার মূল রহস্য জানাতে হবে।
পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ়করণ : অভিভাবকদের সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। অসৎসঙ্গ পরিহার করা এবং সৎসঙ্গ সাধন, মাদকের ছোবল থেকে মুক্ত হতে হবে। কিশোর গ্যাংয়ের পরিবর্তে ‘হিলফুল ফুযুল’ এর আদলে সামাজিক সেবা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, পাঠাগার ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। ছেলেদের যৌতুক প্রদান বন্ধ করে মেয়েদের মহরপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। ছেলেমেয়ে তথা সন্তানের যথাসময়ে বিবাহ নিশ্চিত করতে হবে। মা-বাবা বা অভিভাবকের অনৈতিক সম্পর্ক বা আচরণ ও অসামাজিক কর্মকা- ছাড়তে হবে। অবৈধ সম্পদ উপার্জনের পথ বন্ধ করতে হবে। পর্নোগাফি বন্ধ করতে হবে, ইন্টারনেটের ব্যবহার সুনিয়ন্ত্রিত করতে হবে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও অপসংস্কৃতি রোধ করতে হবে।
সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ : ধর্মীয় বিশ্বাস ও সৎকর্মে উদ্বুদ্ধকরণ, জাতীয় চেতনা ও ন্যায়-নিষ্ঠার শিক্ষাদান, রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার-সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধর্ষকদের রাজনৈতিক অনৈতিক সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে। যথা স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অসাধুতা বন্ধ করতে হবে। প্রশাসনিক দুর্নীতি ও প্রশাসনের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক নিয়োগ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয়ে পদায়ন, পদোন্নতি ও সুবিধা প্রদান বন্ধ করতে হবে। বিচারবিভাগীয় দুর্নীতি ও বিচার বিভাগের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতনের সুবিচারের জন্য যা যা করণীয় : দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। এজন্য প্রত্যেক জেলায় বিশেষ কোর্ট স্থাপন ও ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করা যায়। মামলার এজাহার লেখা, তদন্ত করা ও ধর্ষিতার জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি মহিলা পুলিশ বা নারী কর্মকর্তার দ্বারা করতে হবে। ধর্ষিতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা নারী চিকিৎসক দ্বারা করাতে হবে। নারী আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে মামলা পরিচালনা করতে হবে। নারী বিচারকের মাধ্যমে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে।
উল্লেখ্য, একজন নারী বা শিশু নির্যাতিতা হওয়ার পর আদালতে বিচার প্রার্থনা করলে বহুলাংশে নাজেহাল হতে হয়। নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো জঘন্য কাজ যতটা সহজে ঘটানো যায়; কিন্তু এটা প্রমাণ করা ততটাই কঠিন বিষয়। বিচারকালে নির্যাতিতা তার নিজের অতীত ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে সংকোচবোধ করে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : অভিযোগের ক্ষেত্রে অপরাধী নারী ও শিশু নির্যাতনকারীর দলীয় বা সামাজিক পরিচয় উত্থাপন করা যাবে না। বিচারের সময়ও অপরাধীর দলীয় বা সামাজিক পরিচয় বিবেচনা করা যাবে না। এই উভয়বিধ কারণে বিচার বাধাগ্রস্ত হয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম, ঢাকা