যৌবনের ইবাদত আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। কেননা, তখন যুবকের মধ্যে যৌবনদীপ্ত উত্তেজনা ও তারুণ্যদীপ্ত উন্মাদনা প্রবলভাবে কাজ করে। চারদিকে গোনাহ ও অশ্লীলতার হাতছানি থাকে। হাতের নাগালেই রকমারি পাপের সুযোগ থাকে। যৌবনের মৌবনে পাপাচারের সয়লাবে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে মনে চায়। স্বভাবজাত এ উচ্ছল তারুণ্যকে যখন সে আল্লাহর জন্য বিসর্জন দিয়ে লেগে যায় নেকি অর্জনের প্রতিযোগিতায়, তখন জান্নাতের স্বপ্নীল ভুবন ও অপরূপা হুরদল থাকে তার অপেক্ষায়। তার জীবন হয় ঈমানি আবেশে প্রাণময়, ধর্মীয় ভাবাবেগে মধুময়। সে একদিকে যেমন লাভ করে পার্থিব জীবনের সুখ শান্তি, তেমনি অনন্ত জীবনেও হয় চিরস্থায়ী জান্নাতের অধিবাসী। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদের আপ্যায়নের জন্য অবশ্যই ফেরদাউসের উদ্যান রয়েছে। তাতে তারা সর্বদা থাকবে। সেখান থেকে তারা অন্য কোথাও যেতে চাইবে না।’ (সুরা কাহফ : ১০৭-১০৮)।
যৌবনের ইবাদতে আরশের ছায়া মেলে : বুদ্ধিমান যুবক যৌবনকে আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে নিজের নাম লেখাতে পারে ভাগ্যবান সেই সাত শ্রেণির সোনালি তালিকায়, যাদেরকে মহান রব কেয়ামতের বিভীষিকাময় কঠিন মুহূর্তে আরশের ছায়ায় ঠাঁই দেবেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তাদের একজন হলো ওই যুবক, যে আল্লাহর ইবাদতে বেড়ে উঠেছে।’ (বোখারি : ৬৮০৬)।
যে নালে উৎপত্তি সে নালেই বিনাশ : তারুণ্যের সঙ্ঘবদ্ধ কাফেলা আদিকাল থেকেই পৃথিবীজুড়ে বিলিয়ে চলেছে স্বপ্নের পিদিম। তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও মুষ্টিবদ্ধ অঙ্গীকারে গড়ে ওঠে একটি আদর্শ সমাজ, তৈরি হয় আলোকিত দেশ। কিন্তু যন্ত্রণার কথা হলো, বর্তমান যুবকরা নিজেদের ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা ভুলতে বসেছে। সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি, জিনা-ব্যভিচারসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। আজ তারুণ্যের আগুনেই বীভৎসরূপে পুড়ছে মানবতা। পিতাহারা শিশু, সন্তানহারা মা এবং স্বামীহারা স্ত্রীর বুকফাটা আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে বাংলার আকাশ-বাতাস। এ যেন ‘যে নালে উৎপত্তি, সে নালেই বিনাশ’-এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। অপরিণামদর্শী যুবকরাই ক্ষমতাধর পাপিষ্ঠদের পক্ষ নিয়ে নিজেদের জীবনকে কলঙ্কিত করছে। পরাক্রমশালী রবের এ আয়াত কি তাদের কর্ণগোচর হয়নি? ‘যারা সীমালংঘন করেছে, তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না; পড়লে আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে। তখন আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক থাকবে না এবং তোমাদের কোনো সাহায্য করা হবে না।’ (সুরা হুদ : ১১৩)।
সহসাই বাজতে পারে মৃত্যুর ঘণ্টা : অনেক যুবকের নৈতিক অবক্ষয় এ কারণে হয়, তাদের ধারণা হচ্ছে, এ ভরা যৌবনে কি মৃত্যুদানব হানা দেবে? বয়োজ্যেষ্ঠ ও বৃদ্ধ হওয়ার আগে মৃত্যুর কল্পনাও তো করা যায় না! চুল-দাড়ি পাকার পর আল্লাহর অলি হয়ে সোজা জান্নাতে চলে যাবে! বস্তুত এটা আকাশ-কুসুম কল্পনা বৈ কী! তারা কি দেখে না, প্রতিদিন হাজারো টগবগে যুবক আকস্মিক মৃত্যুর ভয়াল থাবায় পাড়ি জমাচ্ছে পরপারে? কেউ সড়ক দুর্ঘটনায়, কেউ বা রোগের যন্ত্রণায়, কেউ দুর্যোগ-বিপর্যয়ের তীব্রতায়! যাদের ছিল বুকভরা স্বপ্ন, মনভরা আশা! যারা হয়তো ভেবেছিল, বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়ার পর নিজেকে শুধরে নেবে তওবা করে! তাদের কি সে সুযোগ মিলল? আল্লাহতায়ালা কত মর্মস্পর্শী ভাষায় বলেছেন, ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য এক নির্দিষ্ট সময় আছে। যখন সে সময় এসে পড়ে, তখন তারা এক মুহূর্তও তার সামনে বা পেছনে যেতে পারে না।’ (সুরা আরাফ : ৩৪)। ভুলে গেলে চলবে না, দুনিয়াতে আসার সিরিয়াল আছে, কিন্তু যাওয়ার কোনো সিরিয়াল নেই। তাই তো দেখা যায়, পিতার হাতে ছেলের লাশ এবং দাদার কাঁধে নাতির লাশ। অতএব, যৌবনকে পাপমুক্ত রেখে আল্লাহর আনুগত্যে রঙিন করা এবং মৃত্যুর জন্য সদা প্রস্তুত থাকাই শুভ বুদ্ধির পরিচয়।
পাপিষ্ঠ যুবকের নিত্যসঙ্গী শয়তান : যে যুবক শয়তানের প্রবঞ্চনায় যৌবনের উচ্ছল তরঙ্গে হারিয়ে যায়, পাপাচারের ভয়াল রাজ্যে নিজেকে বিলীন করে দেয়, তখন সে মুক্তির রাজপথ হারিয়ে দোজখের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যায়। তার মাধ্যমে ঘটতে থাকে একের পর এক জঘন্য অপরাধ। তার হাতেই মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত হয়। বিনষ্ট হয় দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা। বাহ্যিকভাবে তার মুখে রাক্ষসের হাসি দেখা দিলেও বাস্তবে তার জীবন হয়ে পড়ে সংকীর্ণ, দুর্বিষহ। তার পাষ- হৃদয় থাকে শত উদ্বিগ্ন। আত্মিক প্রশান্তির ছোঁয়াও পায় না সে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন হবে বড় সংকটময়। কেয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ করে তুলব।’ সে বলবে, ‘হে রব! তুমি আমাকে অন্ধ করে তুললে কেন? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম!’ আল্লাহ বলবেন, ‘এভাবেই তোমার কাছে আমার আয়াতগুলো এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিল। আজ সেভাবেই তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে।’ (সুরা তহা : ১২৪-১২৬)।
যুবসমাজের চারিত্রিক অবক্ষয়ের প্রতিকার : জাতির কর্ণধার যুবকদের ক্রমবর্ধমান এ অধঃপতনের জোয়ারকে থামাতে হলে তাদের ইসলামের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। ছোটকাল থেকেই আলোকিত মানুষরূপে গড়ে তুলতে হবে পরম স্নেহ-মমতায় ও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায়। তুলে ধরতে হবে তাদের সামনে ইসলামের অনন্য সৌন্দর্য। ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুন, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ফোকাস করতে হবে তাদের কাছে। উম্মাহর ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি শিশু-কিশোরদের আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলার এ গুরুদায়িত্ব সর্বাগ্রে পালন করতে হবে পিতামাতাকেই। সেই সঙ্গে তাদের অসৎ সঙ্গ থেকে বিরত রাখতে হবে। সৎ সঙ্গে অভ্যস্ত করাতে হবে। তাদের ব্যাপারে অভিভাবকদের যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের প্রত্যেকেই অধীনস্থদের দায়িত্বশীল। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ : ২০৫)।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম