সমাজে নারী সাহাবিদের অবদান
নুসরাত জাহান আয়েশা
প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আশরাফুল মাখলুকাতের মধ্যে নারীরা আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। শুধু পারিবারিক জীবনই নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে নারীরা তাদের মেধা-মনন দিয়ে জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যখন সাহাবিদের মধ্যে পুরুষদের অধিকাংশই বৈষয়িক ও ধর্মীয় জ্ঞানে আগ্রহী ছিলেন, তখন নারী সাহাবিরাও তাদের জ্ঞানচর্চায় অবদান রাখেন। ইসলামের মহান শিক্ষা শুধু পুরুষদের জন্য নয়, নারীদের জন্যও সমভাবে উন্মুক্ত ছিল। নারী সাহাবিরা প্রমাণ করেছিলেন, তারা শুধু গৃহকর্ম বা পরিবার পরিচালনায় সীমাবদ্ধ নন, তারা ধর্মীয়, সামাজিক ও বৈষয়িক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করে সমাজে ভূমিকা পালন করতেও সক্ষম। তাদের অমূল্য অবদান আজও ইসলামি জ্ঞানচর্চায় প্রেরণা। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নারী সাহাবিদের মধ্যে আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা.)-এর নাম সবার আগে স্মরণীয়। তিনি কোরআন-হাদিস, ইসলামি আইন এমনকি রাজনৈতিক বিষয়ে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। আয়েশা (রা.) অধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিদের একজন। কোরআনের তাফসির বর্ণনা, রাসুল (সা.)-এর হাদিস বর্ণনা ও হাদিসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে সারা বিশ্বে তিনি সমস্ত নারী সাহাবিদের তুলনায় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২২১০। আবু মুসা আশআরি (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে কারো কাছে কোনো হাদিস বোঝা কষ্টসাধ্য হলে আয়েশা (রা.)-কে প্রশ্ন করা হতো। তার কাছে এর সঠিক জ্ঞান লাভ করতাম।’ (তিরমিজি : ৩৮৮৩)। উম্মে সালামা (রা.) ৩৭৮টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া হাফসা (রা.), সাফিয়া (রা.), উম্মে হাবিবা (রা.), ফাতেমা (রা.), জুওয়াইরিয়া (রা.), আসমা বিনতে আবু বকর (রা.), উম্মে আতিয়া (রা.), ফাতেমা বিনতে কায়েস (রা.), উম্মে হানি (রা.), আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.)-সহ প্রমুখ নারী সাহাবি বহুসংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন।
ফিকহশাস্ত্রে অবদান : ফিকহশাস্ত্রে নারী সাহাবিদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। আয়েশা (রা.) থেকে এত অধিক ফতোয়া বর্ণিত হয়েছে, যা একত্র করলে একটি বড় বই হয়ে যাবে। অনুরূপ উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত ফতোয়াসমূহ একটি পুস্তিকার আকার ধারণ করবে। ফতোয়া দানকারী নারী সাহাবিদের মধ্যে হাফসা (রা.), উম্মে হাবিবা (রা.), উম্মে আতিয়া (রা.), সাফিয়া (রা), লায়লা বিনতে কায়েস (রা.), উম্মে দারদা (রা.), যয়নাব বিনতে উম্মে সালামা (রা.), আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ফারায়েজ (মৃতব্যক্তির ওয়ারিশ সম্পর্কিত বণ্টননীতি) বিষয়ে আয়েশা (রা.)-সহ অন্যান্য নারী সাহাবিরাও পারদর্শী ছিলেন। জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক নারী-পুরুষ নারী সাহাবিদের শরণাপন্ন হতেন। এসব মহীয়সী নারী তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার দ্বারা মুসলিম উম্মাহকে সকল সমস্যার সমাধান দিয়ে সাহায্য করেন। এমনকি অনেকে কোরআনুল কারিমের দরস দিতেন। রাবেতা বিনতে হায়্যান, উম্মে ইমাম বিনতে হারিসা, হিন্দ বিনতে উবায়েদ, উম্মে সাদ ইবনে রাবি (রা.)-সহ প্রমুখ নারী সাহাবি পবিত্র কোরআনের বেশির ভাগ আয়াতের হাফেজা ছিলেন।
আরবি সাহিত্যে ভূমিকা : আরবি সাহিত্যে নারী সাহাবিদের অতুলনীয় অবদান রয়েছে। খানসা বিনতে আমর ইবনুশ শারিদ (রা.) একজন বিখ্যাত কবি ও সাহাবি ছিলেন। আরবি সাহিত্যে নারী কবিদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও বিশেষভাবে খ্যাত। তার ভাই শাখর ইবনে আমর এবং মুয়াবিয়া ইবনে আমরের মৃত্যুতে শোকগাথা রচনা করে আরবি সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। ইসলাম নিয়ে যেসব জাহেলি কবি ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করত, তিনি কবিতা দিয়েই সেগুলোর জবাব দিতেন। এ ছাড়া আয়েশা (রা.) কবিতা রচনা করতেন। তিনি বহু কবিতা কণ্ঠস্থ করেছিলেন। কবিতা আবৃত্তিও করতেন। তিনি একজন কবি, ঐতিহাসিক, ফিকহ ও হাদিস বিশেষজ্ঞ ছিলেন। অন্যদের মধ্যে সাওদা, উমামা, হিন্দ বিনতে হারিস, উম্মে আইমান, মাইমুনা, রুকাইয়া, আতিকা বিনতে জায়েদ, কসবা বিনতে রাফে, বালাবিয়া (রা.)-সহ প্রমুখ নারী সাহাবি কবিতায় অনেক খ্যাতি লাভ করেন।
রাজনীতিতে বিশেষ পরামর্শ : রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক প্রতিভাবান নারী সাহাবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-এর শাসনামলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে পরামর্শ করতেন। তার সিদ্ধান্তকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। শিফা বিনতে আবদিল্লাহ (রা.)-এর সিদ্ধান্তকে ওমর (রা.) অনুমোদন করতেন। তিনি নারী বিষয়ক কোনো সরকারি কাজের দায়িত্ব শিফা (রা.)-কে দিতেন। নারী ইসলামের বিধান মেনে পর্দায় থেকে রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার বহু উদাহরণ রয়েছে ইসলামি ইতিহাসে। নারীর রাজনীতি মানে মাঠে বেপর্দায় নেমে পড়া নয়। জ্ঞানদীপ্ত পরিকল্পনা, পরামর্শ ও সমাজ গঠনে বিবিধ সহায়তা করার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে নারীরা পুরুষদের সহযোগী হতে পারে। পূর্ববর্তী নারীরা এভাবেই অনেক কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শিতা : অনেক নারী সাহাবি ইলমে তিব্ব বা চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে ইলমে তিব্ব বিদ্যায় পারদর্শী নারীরা মুজাহিদ সৈন্যদের সেবায় নিয়োজিত হতেন। শিফা (রা.) চর্মরোগের চিকিৎসা জানতেন; যা তিনি নবিপত্নী হাফসা (রা.)-কেও শিখিয়েছিলেন। রাসুল (সা.) অসুস্থ হলে আরবের তিব্ব বিদ্যায় বিশেষজ্ঞরা তার চিকিৎসার ব্যাপারে যা আলোচনা করতেন, আয়েশা (রা.) তাই মনে রাখতেন। তিনি বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক সম্পর্কে শিক্ষালাভ করেন। পরবর্তীতে সেসব বিষয়ে নারীদের শিক্ষা দেন।
