যাপিত জীবনে ধর্মের আবশ্যকতা
উবাইদুল্লাহ তারানগরী
প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ধর্ম মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম চির শান্তি ও একমাত্র মনোনীত ধর্ম। ইসলাম যেমন আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলে, তেমনি জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে তার বিধান মেনে চলার নির্দেশ দেয়। তাই ধর্ম মানে শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত নয়; বরং ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক- জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় সমাজ যতই উন্নতি লাভ করুক, ঈমান ও আল্লাহভীতি ছাড়া মানবতাসম্পন্ন ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে উঠবে না। আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা ইসলামধর্মে পূর্ণভাবে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না।’ (সুরা বাকারা : ২০৮)।
এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, ধর্মীয় জীবন কোনো আংশিক ব্যাপার নয়; বরং সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম। যে ব্যক্তি শুধু ইবাদতের ক্ষেত্রে ধর্ম মানবে, কিন্তু লেনদেন, নৈতিকতা বা রাজনীতিতে নিজের ইচ্ছামতো চলবে, সে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলাম অনুসরণ করবে না। আর পূর্ণাঙ্গ ইসলাম না মানলে সফলতা অর্জিত হবে না। আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? তোমাদের মধ্যে যারা এটা করে, তাদের প্রতিদান দুনিয়ার জীবনে অপমান ছাড়া আর কিছু নয়। আর কেয়ামতের দিন তাদের কঠিনতম শাস্তির দিকে ফেরানো হবে। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা অগোচরে রাখেন না।’ (সুরা বাকারা : ৮৫)।
জীবনযাপনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা : মানুষের শুধু দেহ নয়, আত্মাও আছে। দেহের খাদ্য যেমন উপকরণ, আত্মার খাদ্য তেমন ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা। আত্মা যদি ধর্মীয় শিক্ষা ও আমলের আলো থেকে বঞ্চিত হয়, তবে মানুষের ভেতর অসন্তোষ, উদ্বেগ, লোভ ও হতাশা দানা বাঁধে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই হতাশা পরিবেশকেও প্রভাবিত করে। ধর্মীয় জীবন অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে, নৈতিক চরিত্র গড়ে তোলে, অন্যের প্রতি করুণা, ন্যায়বোধ জাগিয়ে দেয়। মানুষের আচরণ-উচ্চারণ তখনই সুন্দর হবে, যখন তার ভেতর সুন্দর হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রেখ, মানুষের দেহে এক টুকরো গোশত আছে; তা ভালো হলে পুরো দেহ ভালো হয়, আর তা নষ্ট হলে পুরো শরীর নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রেখ, সেটি হলো অন্তর।’ (বোখারি : ৫২, মুসলিম : ১৫৯৯)।
ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের প্রভাব : একজন ধর্মপরায়ণ মানুষ নিজের সময় ও কাজের সঠিক হিসেব রাখে। নামাজের সময় ঠিক রাখা, রোজায় ধৈর্য ও তাকওয়ার অনুশীলন, বিপদ ও দারিদ্র্যে মুষড়ে না পড়া, হারাম থেকে বাঁচা- এসব তাকে আত্মনিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। একজন নামাজি ভোরের শিশিরমাখা গোলাপের মতো আবহাওয়া ও জীবন যেভাবে উপভোগ করেন, নামাজবিহীন তা কখনোই সম্ভব নয়। নামাজ শুধু আধ্যাত্মিক প্রশান্তিই দেয় না, দৈনন্দিন জীবনে শৃঙ্খলার অপূর্ব ছোঁয়া আনে। আল্লাহ বলেন, ‘নামাজ অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সুরা আনকাবুত : ৪৫)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে নামাজে।’ (সুনানে নাসায়ি : ৩৯৪০)।
ধর্মের প্রভাব পারিবারিক জীবনে : যারা ইসলামের আলোয় নিজেকে আলোকিত করেছে, সুন্নাহর রঙে জীবন রাঙিয়েছে, পারিবারিকভাবেও তারা সুখী। সন্তানের সামনে স্বামী-স্ত্রীর সুন্দর আচরণসহ সবকিছুতেই নববি আদর্শের ছায়া পড়ে। ফলে ধর্মীয় জীবন পরিবারে শান্তি ও ভালোবাসা আনে। পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়দের প্রতি সদাচরণ, হালাল উপার্জন ও সন্তানের সঠিক লালনপালন- এসব ইসলামধর্মের শিক্ষা। যদি পরিবারে সবাই ইসলামের আলোকে চলার চেষ্টা করে, তাহলে সেখানে অবিশ্বাস, প্রতারণা বা অশান্তি বাসা বাঁধে না। কোনো ধার্মিক সন্তানের মা-বাবাকে কোনোদিন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি তোমাদের মধ্যে পরিবারের কাছে সর্বোত্তম।’ (তিরমিজি : ৩৮৯৫)।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইসলাম : ইসলাম সততা, ন্যায়বিচার, পরস্পরের অধিকার রক্ষা এবং দুর্বলদের সাহায্যের নির্দেশ দেয়। একটি সমাজে যদি ধর্মীয় জীবনপ্রবাহ শক্তিশালী হয়, তাহলে দুর্নীতি, শোষণ, হিংসা-বিদ্বেষ কমে আসে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলাম সুদ ও জুলুম নিষিদ্ধ করেছে এবং হালাল উপার্জন ও জাকাতের মাধ্যমে ধনী-গরিবের মাঝে সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন, তোমরা আমানত তার হকদারকে ফিরিয়ে দেবে এবং মানুষের মাঝে বিচার করলে ন্যায়বিচার করবে।’ (সুরা নিসা : ৫৮)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘তাদের সম্পদ থেকে জাকাত নাও। এর দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র ও শুদ্ধ করবে।’ (সুরা তাওবা : ১০৩)।
রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রজীবনে ইসলামের প্রভাব : ইসলাম শুধু ব্যক্তি ও সমাজ নয়, রাষ্ট্র পরিচালনাতেও আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন- কীভাবে ন্যায়, সমতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়া যায়। কারণ, আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, ‘যারা শাসনক্ষমতা পায়, তারা যেন মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার করে।’ (সুরা নিসা : ৫৮)।
ধর্মীয় জীবন ও আত্মিক প্রশান্তি : জীবনে নানা দুঃখ-কষ্ট, পরীক্ষা ও চ্যালেঞ্জ আসে। ধর্মীয় জীবন সে সময় মানুষকে ধৈর্য ও আশাবাদী হতে শেখায়। নিরাশ হতে বারণ করে এমন শান্তির বাতায়ন খুলে দেয়, যা কোনো মূল্যে পাওয়া যায় না। শুধু আল্লাহর স্মরণ ও ধর্মের আলো ও স্নিগ্ধ পরশেই মেলে। আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার সেই বান্দারা, যারা নিজেদের প্রতি সীমালঙ্ঘন করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করেন। তিনি পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।’ (সুরা যুমার : ৫৩)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ : ২৮)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘নিশ্চয় কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি।’ (সুরা ইনশিরাহ : ৫)।
ধর্মহীন জীবনের পরিণাম ও ক্ষতি : যদি সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে যায়, তখন সেখানে নৈতিক অবক্ষয়, স্বার্থপরতা, হিংস্রতা, অপরাধ ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। ইতিহাস সাক্ষী, যে জাতি আল্লাহর বিধান ত্যাগ করেছে, তারা শেষ পর্যন্ত অভিশাপের মুখে পড়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে। যাপিত জীবনে ইসলামি গাইডলাইন কোনো বাঁধা নয়, বরং জীবনের সঠিক দিকনির্দেশনা, জীবনদাতার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করা। এটি মানুষকে শুধু দুনিয়াতে নয়, পরকালেও সফলতার নিশ্চয়তা দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পরকালের ভাবনাকেই একমাত্র সঙ্গী বানায়, আল্লাহ তার দুনিয়ার চিন্তাগুলো দূর করে দেন। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার নানা চিন্তায় ব্যস্ত থাকে, আল্লাহ তার পরোয়া করেন না- সে দুনিয়ার যে উপত্যকায় ধ্বংস হয়, হোক না কেন!’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪১০৫)।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
