আমার সংগ্রাম আমার ইবাদত
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

লেখালেখি একটি নান্দনিক শিল্প। ইসলামে লেখনীর গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম লেখার প্রথা প্রবর্তন করেন। তিনি এ পার্থিব জগৎকে সৃষ্টি করার ৫০ হাজার বছর আগেই সমগ্র সৃষ্টিজীবের ‘ভাগ্য’ লিখেছেন। কলমকে তিনি মর্যাদাসম্পন্ন বস্তু হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর লেখক হচ্ছেন মর্যাদাশালী। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের কয়েক আয়াতে কলমের শপথ করেছেন। যেমন বলেছেন, ‘নুন ও কলমের শপথ এবং ওই বস্তুর শপথ! যা তারা লেখে।’ (সুরা কলম : ১)।
শহিদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কালি উত্তম : ইসলাম বিদ্যার্থীর কলমের কালিকে অত্যন্ত মর্যাদার চোখে দেখে। সামর্থ্য থাকাসত্ত্বেও যারা লেখে না, ইসলাম মনে করে, সে নিজের এবং অন্যের অধিকার নষ্ট করছে। নিজের অধিকার নষ্টের অর্থ হলো, নিজেকে ফলপ্রসূ হওয়া থেকে বঞ্চিত করা, উত্তম কাজগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা। ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে জানতে না দেওয়া। আর অন্যের অধিকারের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, সাধারণ মানুষ তার সারগর্ভ দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে পথহারা অনেক মানুষ সত্য ও সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারেনি। সেজন্য লেখালেখি সদকায়ে জারিয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো মানুষ মারা যায়, তখন তার সমস্ত আমলের সওয়াব বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের সওয়াব বন্ধ হয় না। তা হলো- এক. তার সদকায়ে জারিয়া, দুই. তার প্রবর্তিত এমন কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়, তিন. তার রেখে যাওয়া এমন সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম : ১৬৩১)। লেখা যেহেতু লেখকের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকবে, তাই ভালো লেখার জন্য লেখক অনন্তকাল কবরে শুয়ে নেকির ভাগিদার হতে থাকবেন। তেমনি আরেক হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় সৎকাজের পথপ্রদর্শক তা সম্পাদনকারীর অনুরূপ।’ (তিরমিজি : ২৬৭০)।
আদর্শ সমাজ গঠনে আলোকবর্তিকা : একটি লেখা শুধু সমকালীন মানুষকেই লাভবান করে না, বরং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আদর্শ সমাজ গঠনে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। অব্যবহৃত সম্পদ অর্থহীন হয়ে পড়ে। যারা লেখেন না, তাদের ভেতরের জ্ঞান এভাবেই অর্থহীন হয়ে পড়ে। তারা যদি লিখতেন, তাহলে নিজেদের যেমন জ্ঞানচর্চা হতো, তেমনি নিজেরা সমৃদ্ধ হতেন। আবার অন্যরাও তা পড়ে জ্ঞানের অনুশীলন করতে পারত। দিকনির্দেশনা পেয়ে সঠিক পথে চলতে পারত। লেখালেখির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিশ্বখ্যাত মনীষী সাইয়িদ আবুল হাসান আলি নদবি (রহ.) বলেছিলেন, ‘যুগ এখন নতুন খালিদ বিন ওয়ালিদ ও নতুন আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)-এর অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের নমুনা তো কেয়ামত পর্যন্ত আর কেউ হতে পারবে না। কিন্তু আমি শুনতে পাই, তাদের আত্মা যেন তোমাদের ডেকে বলছে, তলোয়ারের জিহাদ তো আমরা করেছি। বুকের রক্ত যত প্রয়োজন, ঢেলে দিয়েছি। যখনই ডাক এসেছে, একমুহূর্ত বিলম্ব করিনি। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছি। কিন্তু আজ রক্তের জিহাদের যতটা প্রয়োজন, চিন্তার জিহাদের প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি। ধারালো তলোয়ারের যতটা প্রয়োজন, শাণিত কলমের প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি। বাতিলের বিরুদ্ধে তোমাদের আজ শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ময়দানে এবং চিন্তা-মতবাদ ও দর্শনের জগতে লড়তে হবে। কেননা, নবুওয়তে মুহাম্মদির ওপর এখন তলোয়ারের হামলা যতটা না চলছে, তার চেয়ে বেশি চলছে যুক্তি-দর্শনের আক্রমণ। সুতরাং নতুন যুগের নতুন জিহাদের জন্য তোমরা একদল মুজাহিদ তৈরি হও।’
লেখালেখি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ : একজন লেখকের জন্য তার সাহিত্যকর্মকে মনীষার বাহনরূপে নয়, ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্বের প্রকাশ মাধ্যমরূপে এবং সমাজ চৈতন্যের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিমারূপে দেখতে হয়। লেখককে অনস্বীকার্যভাবে কুসংস্কার, ভীরুতা, জরাজীর্ণতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সত্য-সুন্দরের আরাধনা করতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যায় নিমগ্ন হতে হয়। তাই লেখালেখি অনেকটাই সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ। আমার লেখালেখি আমার ইবাদত। সাহিত্য আমার আরাধ্য। পৃথিবীর যেকোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য লেখালেখির গুরুত্ব অনেক। আদর্শকে পাঠকের কাছে নিপুণ করে ফুটিয়ে তোলাই দক্ষ লেখকের কাজ। আদর্শ লেখকরা লিখনীর মাধ্যমে মানুষকে সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান করেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের উপকরণ যোগান। প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরেন। সর্বোপরি সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখেন। এভাবে তারা সবার হৃদয়ে একটা জায়গা করে নেন। হয়ে ওঠেন আত্মার পরম আত্মীয়।
সাহিত্যচর্চা অন্যতম সংগ্রাম ও ইবাদত : লেখালেখি বা কলমের মাধ্যমে বিশ্বময় ইসলামের দাওয়াতের কাজ ছড়িয়ে দেওয়া যায়। ইসলামে দাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআন-হাদিসে এ কাজের অত্যধিক গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। সভ্যতার বিকাশেও লেখালেখির ভূমিকা অপরিসীম। যুগ পরম্পরায় জ্ঞানের বিকাশ ও সংরক্ষণের মাধ্যম হয়ে এসেছে লেখালেখি। নানা গ্রন্থে তা সংরক্ষিত রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। জ্ঞানীদের লেখা হাজারো গ্রন্থ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিশ্বের সব সেরা গ্রন্থাগারে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা পড়ানো হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে জ্ঞানী-বিজ্ঞানী। এসব যদি না লেখা হতো, তবে কালের আবর্তে সব বিলীন হয়ে যেত। আজ সভ্যতার যে সুরম্য প্রাসাদ আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে, তার কোনো চিহ্ন থাকত না। লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চা অন্যতম একটি সংগ্রাম। ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে ইবাদতও। লেখা আল্লাহর দান। আল্লাহতায়ালা সবাইকে সব বিষয়ে লেখার যোগ্যতা দান করেননি। এ কারণেই সবাই সব বিষয়ে লিখতে অপারগ। আবার মনোযোগী পাঠক ছাড়া লেখক হওয়া দুরূহ ব্যাপার। দুনিয়াতে বড় লেখক হয়ে কেউ জন্ম নেয় না। আবার কেউ হঠাৎ করে বড় লেখক হয়ে যায় না। লেখার সামান্য যোগ্যতা যাদের আছে, তাদের লেখাকে অভ্যাসে পরিণত করলে ভালো ফলাফল আশা করা যায়। লেখক হতে চাইলে তাই নিরন্তর সাধনায় ডুব দিতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন প্রতিভা, আত্মপ্রত্যয়, দৃঢ় সংকল্প, ধৈর্য এবং প্রচুর অধ্যবসায়।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক, অনুবাদক ও সম্পাদক
