ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কালোজিরা কি সকল রোগের মহৌষধ?

আরজু আহমাদ
কালোজিরা কি সকল রোগের মহৌষধ?

এ কথা নির্দ্বিধায় সত্য যে প্রসিদ্ধ দুই হাদীস গ্রন্থ বোখারি ও মুসলিমসহ আরও বহু গ্রন্থে একাধিক বর্ণনাকারী থেকে এই হাদিস বর্ণিত আছেÑ ‘কালোজিরা ‘সাম’ ব্যতীত সব রোগের ওষুধ স্বরূপ।’ আর এই ‘সাম’ মানে হচ্ছে মৃত্যু। কিন্তু বহুজন কেবলমাত্র বাণিজ্যিক কারণে কোনো প্রকার ব্যাখ্যাহীন এই হাদিসের যে সর্বময় ব্যবহার করেন সে প্রবণতা থেকে আমাদের বেরুনো উচিত। ন্যূনতম হলেও এর অন্তর্নিহিত ভাব প্রসঙ্গে আমাদের ধারণা রাখা প্রয়োজন।

এই হাদিসের আক্ষরিক অর্থের ওপর বিশ্বাস রেখে কেউ কালোজিরা সেবন করতে শুরু করল। দেখা গেল, এতে আরোগ্য মিলল না। তখন কারও কারও ক্ষেত্রে শয়তানের প্ররোচনায় হাদিসের ওপর সন্দিহান হয়ে পড়ার যে আশঙ্কা সে সম্ভাবনা তো উপেক্ষা করা যায় না।

যা হোক, কালোজিরা সংক্রান্ত এই হাদিসসমূহের ওপর আমাদের পূর্ববর্তী ইসলামের তারকাতুল্য অসংখ্য হাদিস বিশারদগণ বহু সবিস্তার মত ব্যক্ত করেছেন। সে সব মতসমূহকে দু’ভাগে আলাদা করা যেতে পারে।

১। যে সমস্ত আলেম এই হাদিসের সরলার্থকে গ্রহণ করেছেন (ধপপড়ৎফরহম ঃড় মবহবৎধষ সবধহরহম)। ইবনে আবি যামরা, ইবনে তাইমিয়া, শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইউসুফ কিরমানি (রহ.) তাদের মধ্যে প্রধানতম।

এ ক্ষেত্রে ইবনে আবি যামরার অভিমত হচ্ছে, যারা চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছেন, কালোজিরা কিছু রোগে ওষুধ হিসেবে কাজ করবে এবং কিছু রোগের ক্ষেত্রে কাজ করবে নাÑ তারা ওহির ইলমের থেকে মানুষের বিবেচনাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফলত চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার ওপর নয় আমাদের হাদিসের ওপরই বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলছেন, যেহেতু হাদিসে ‘সাম’ তথা ‘মৃত্যু’ ব্যতিত সব রোগের কথা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ফলত তা প্রত্যেক রোগের জন্যই আরোগ্য স্বরূপ।

২। অন্য একদল আলেম এই হাদিসের ভাবার্থ গ্রহণের কথা বলছেন। ইবনে হাজার, ইবনুল ক্বাইয়্যিম, ইবনুল আরাবি, আল খাত্তাবি প্রমুখসহ বহু প্রসিদ্ধ হাদীসবেত্তাগণ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

ইবনে হাজার আল আসক্বালানীর মতে, ‘সব রোগ’ বলতে কালোজিরা প্রয়োগ করে চিকিৎসা সম্ভবপর এমন সকল রোগকে বোঝানো হয়েছে। কেননা কালোজিরা ঠা-াজনিত অসুস্থতায় কার্যকর। গরমজনিত অসুস্থতায় তা নয়। আল খাত্তাবিও প্রায় একই অভিমত ব্যক্ত করে বলছেন, ‘এটা সাধারণভাবে প্রয়োগ করা হলেও এর উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্ট রোগসমূহ। যেমন, আদ্রতার জন্য সৃষ্ট অসুস্থতায় কালোজিরে কার্যকর।’

ইবনুল আরাবি এবং ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহ.) কোরআন থেকে উদাহরণ টেনে দেখাচ্ছেন, কোরআনেও কখনও সাধারণভাবে সামগ্রিক অর্থে কোনও শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তা সামগ্রিক নয় বরং সুনির্দিষ্ট কিছু অংশকেই বোঝায়। ইবনুল ক্বাইয়্যিম আদ জাতির ওপর প্রেরিত আল্লাহর আজাব প্রসঙ্গে সুরা আহক্বাফের বর্ণনা এনেছেন। যেখানে বলা হচ্ছে, ‘প্রতিপালকের আদেশে সে সব কিছুকে ধ্বংস করে... ঝড় প্রসঙ্গে এই কথা বলা হচ্ছে। পূর্ববর্তী আয়াতেই আল্লাহ তা বলেছেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, সে ঝড় সব ধ্বংস করেছে। বরং যা যা ধ্বংস হওয়ার কেবল তাই হয়েছে। তেমনি হাদিসে কালোজিরার প্রসঙ্গও তাই।

ইবনুল আরাবি বলছেন, কোরআনে আল্লাহ বলছেন, ‘মধুর মধ্যে রয়েছে নিরাময়’। সেখানেও তো তা অধিকাংশ রোগের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে। কিছু কিছু রোগ এমনও আছে, যা মধু খেলে বাড়তে পারে। সেখানে কালোজিরা তো সার্বিক প্রসঙ্গে হতেই পারে না।’

যা হোক, আল্লাহ তাঁদের প্রত্যেকের ওপর রহম করুন। যে সমস্ত ব্যাপারে উলামাদের দ্বিমত রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে নিজের বোঝার সুবিধার্থে আমি সাধারণত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিরাতকে দেখবার চেষ্টা করি। দেখি তিনি নিজে এর ওপর কিভাবে আমল করেছেন।

যদি কালোজিরাই সব রোগের জন্য ওষুধ রূপে ব্যবহার করা যেত তবে তিনি নিশ্চয় জীবনে এর ব্যাপকতর ব্যবহার করতেন। অন্তত বেশিরভাগ রোগের চিকিৎসায়। কিন্তু হাদিসের সংশ্লিষ্ট অংশ এবং সিরাত বিবেচনায় নিলে দেখা রাসুল (সা.) পৃথক পৃথক রোগের জন্য পৃথক পৃথক চিকিৎসা দিয়েছেন।

তিনি মাথা ব্যথার জন্য শিঙ্গা লাগিয়েছেন। নাকে তরল ওষুধ সেবন করেছেন। তিনি চোখের রোগে সুরমা ব্যবহার করতে বলেছেন। তিনি মাশরুমকে চোখের চিকিৎসায় ব্যবহার করতে বলেছেন। জ্বর হলে তিনি পানি ঢালতে বলেছেন। উটের দুধের দ্বারা চিকিৎসা করিয়েছেন। কুষ্ঠের মতো রোগে তিনি আইসোলেশনের কথা বলেছেন। তিনি নিজে তাঁর অসুখ তীব্র হলে সুরা ফালাক্ব ও নাস পড়ে ফু দিতেন। তিনি নানা অসুস্থতায় ঝাড়-ফুঁক করেছেন। আজওয়া খেজুর, যাইতুন ও তালবিনা প্রভৃতি দ্রব্যসমূহকে পৃথক পৃথক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার শিক্ষা দিয়েছেন। শ্বাসনালীর ব্যথায়, পাঁজরের ব্যথায়, আল জিহ্বা ফুলে উঠা (ওহভষধসসধঃরড়হ) এর মতো রোগে তিনি ভারতীয় চন্দনের ব্যবহার করার কথা বলেছেন।

এই সব বর্ণনাই আগ্রহীজন বোখারির চিকিৎসা সংক্রান্ত অধ্যায়ে সবিস্তারে দেখে নিতে পারেন। চিকিৎসা সংক্রান্ত অসংখ্য বর্ণনার মধ্য থেকে আমি কেবল সামান্যই উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছি। তবুও এখান থেকেই ধারণা লাভ করা যায়, ভিন্ন ভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক চিকিৎসার প্রয়োগ খোদ রাসুল (সা.) করেছেন। তিনি সব রোগেই কালোজিরাকে সম্পৃক্ত করেননি। এমনকি কালোজিরা থেকে বহু মূল্য ও আরবে দুর্লভ ভারতীয় চন্দনের ব্যবহার করার কথা অবধিও তিনি বলেছেন। যদি কালোজিরা সব রোগেরই চিকিৎসা হতো, মানে হাদিসকে এঁর সরলার্থেই গ্রহণ করা হতো তবে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এর সমগ্র জীবনজুড়েই এর ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যেত। আমি বিনীতভাবে মনে করি এই হাদিস প্রসঙ্গে ইবনে হাজার, ইবনুল ক্বাইয়্যিম, ইবনুল আরাবি, আল খাত্তাবি (রহ.) এঁর মতোই অধিক প্রণিধানযোগ্য। কালোজিরা অবশ্যই পথ্য ও ওষধি গুণসম্পন্ন। সুতরাং তা খাওয়া উত্তম। সওয়াবের নিয়তেও তা খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কালোজিরা সব রোগের একমাত্র চিকিৎসা নয়। বরং হাদিসে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আরও প্রভূত কল্যাণ নিহিত থাকার জন্যই কালোজিরা খাওয়ায় উৎসাহিত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত