রংপুর অঞ্চলের মানুষের কাছে শতরঞ্জি একটি পরিচিত শব্দ; যা হলো একধরনের কার্পেট। ধনী আভিজাত্য পরিবারে এটির কদর অনেক বেশি। এটি শৌখিনতার এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ। শতরঞ্জি শব্দটি মূলত ফারসি শতরঞ্জ থেকে এসেছে। শতরঞ্জ হলো দাবা খেলার ছক। দাবা খেলার ছকের সঙ্গে শতরঞ্জির নকশার মিল আছে। সেখান থেকেই এ নামটি এসেছে।
রংপুরের শতরঞ্জি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার প্রায় ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশেও রংপুরের শতরঞ্জির ব্যাপক চাহিদা। বর্তমান বিশ্বে বুনন শিল্পের মধ্যে শতরঞ্জি বুনন সবচেয়ে প্রাচীনতম। এ পণ্য উৎপাদনে কোনো যন্ত্রের ব্যবহার করা হয় না। শুধু বাঁশ এবং রশি দিয়ে মাটির উপর সুতো দিয়ে টানা প্রস্তুত করে সুতা গণনা করে হাত দিয়ে নকশা করে শতরঞ্জি তৈরি করা হয়। কোনো জোড়া ছাড়া যে কোনো মাপের শতরঞ্জি তৈরি করা যায়। এর সৌন্দর্য ও টেকসই উল্লেখ করার মতো।
তবে ইদানীং বাঁশের ফর্মায় দেড়-দুই ফুট থেকে ছয়-নয় ফুট সচরাচর শতরঞ্জি তৈরি করা হয়। অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকে ব্রিটিশ নাগরিক মি. নিসবেত তৎকালীন রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। সে সময়ে নিসবেতগঞ্জ মহল্লার নাম ছিল পীরপুর। সেই পীরপুর গ্রামে তৈরি হতো মোট মোটা ডোরাকাটা রং-বেরঙের সুতার তৈরি গালিচা বা শতরঞ্জি। মি. নিসবেত এসব শতরঞ্জি দেখে মুগ্ধ হন। পরবর্তীকালে তিনি শতরঞ্জির গুণগতমান উন্নয়ন এবং এ শিল্পের প্রচার ও প্রসারে সহায়তা প্রদান করেন এবং উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপক বিপণন ব্যবস্থা করেন। এই শিল্পের মান উন্নয়ন ও বিপণন ব্যবস্থায় গুরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য মি. নিসবেতের নামানুসারে পরে গ্রামটির নামকরণ হয় নিসবেতগঞ্জ। নিসবেতগঞ্জের অনেক বাড়িতেই এখন চলে শতরঞ্জি বুননের কাজ। অনেক আগে থেকেই এর প্রচলন থাকলেও বেশ কিছুদিন আগে থেকে এর প্রসারতা লাভ করেছে। ১৯৭৬ সালে সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরির একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু ব্যাপক বাজার সৃষ্টি করতে না পারায় ধীরে ধীরে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে।
আশার কথা হলো যে, ১৯৯৪ সালে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিনা পয়সায় আরও উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে ঐ এলাকার মানুষকে শতরঞ্জি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। সেই থেকে আর থেমে নেই শতরঞ্জির উৎপাদন। এখন নিসবেতগঞ্জের প্রায় বাড়িতেই শোনা যায় শতরঞ্জি উৎপাদনের ঘটাং ঘটাং শব্দ। কালের বিবর্তনে বাংলার মসলিন শিল্প হারিয়ে গেলেও রংপুরের শতরঞ্জি স্বগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। বর্তমান সভ্যতায় কারুশিল্পের প্রতি মানুষের আকর্ষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শতরঞ্জির জন্য অত্যন্ত শুভদিক। বর্তমানে রংপুরের শতরঞ্জি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার প্রায় ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশেও রংপুরের শতরঞ্জির ব্যাপক চাহিদা।
এখন ব্যক্তি পর্যায়ে চলছে শতরঞ্জি তৈরির কাজ। ‘কারুপণ্য’ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে শতরঞ্জি তৈরির পাঁচটি কারখানা। আরও রয়েছে ‘শতরঞ্জি পল্লি, ‘চারুশী’ শতরঞ্জি কারখানা। কারখানা ছাড়াও নিসবেতগঞ্জ এলাকায় বাড়ির আঙিনা কিংবা উঠানে, বাড়ির ছাউনির নিচে নিপুণ হাতে চলছে শতরঞ্জি বুননের কাজ। এসব কারখানায় প্রায় ৫ হাজার নারী-পুরুষ কাজ করছেন। ‘শতরঞ্জি পল্লী’র সিইও রফিকুল ইসলাম দুলাল ও অধুনালুপ্ত ‘নীড় শতরঞ্জি’ প্রতিষ্ঠানের মালিক নজমুল ইসলাম ডালিম জানান, নারায়ণগঞ্জ ও বগুড়ার শাওয়াল থেকে সুতা এনে কারিগরদের দিতে হয়। অনেকটা নমুনা ছাড়াই নিপুণ হাতে কাজ করেন নারী ও পুরুষ কারিগররা। তারা প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৭ টাকা দরে কাজ করে থাকেন। এভাবেই একেকজন কারিগর প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত শতরঞ্জি তৈরি করতে পারেন। প্রতিদিন আয় হয় একেকজনের ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। এ টাকা তাদের প্রতিদিন, কখনও সপ্তাহে আবার কখনও মাস শেষে প্রদান করা হয়। কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের বাঁধাধরা কোনো সময় নেই। যে যখন পারেন তখনই কাজ করতে পারেন।
নিসবেতগঞ্জ, চারুশী শতরঞ্জি ও হস্ত শিল্পজাত পণ্য, প্রোপ্রাইটার তহুরা বেগম জানান, রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি, টেবিল ম্যাট, ব্যাগ, জায়নামাজ, পাটের পাপোশ, পাটের ব্যাগসহ ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, এখানে প্রায় ১০০ মহিলা কাজ করেন, তারা বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। এসব পণ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও বিদেশে রপ্তানি হয়ে আসছে।
তারা জানান, শতরঞ্জির ক্রেতা মূলত ধনিক শ্রেণির মানুষ। শৌখিনতার বশে এসব শতরঞ্জি কিনে তারা ওয়ালম্যাট ও রুমের কার্পেট হিসেবে ব্যবহার করেন। তাদের উৎপাদিত শতরঞ্জি প্রতি বর্গফুট রকমভেদে ৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। তাদের শোরুমে ২২০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৩২০ টাকা পর্যন্ত মূল্যের শতরঞ্জি লক্ষ্য করা যায়।
এক পরিসংখ্যানে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্যে হস্তশিল্পের ৬০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে থাকে রংপুরের শতরঞ্জি। বিগত তিন বছরে গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ ডলার দেশে আনা সম্ভব হয়েছে এখানকার উৎপাদিত শতরঞ্জির মাধ্যমে। ঘাঘট নদীর তীর ঘেঁষা অজপাড়া গা নিসবেতগঞ্জ থেকে শতরঞ্জি রপ্তানি হওয়ায় আরও নতুন উদ্যমে বাড়ি বাড়ি তৈরি হচ্ছে শতরঞ্জি।
কারুপণ্যের জনসংযোগ উপদেষ্টা মাহাবুব রহমান হাবু বিদেশে শতরঞ্জির রপ্তানির বিষয়টির প্রসঙ্গে বলেন, বিভিন্ন বড় বড় এনজিও প্রতিষ্ঠানসহ তিনটি বায়ার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শতরঞ্জিগুলো রপ্তানি হয়ে থাকে। বায়ার প্রতিষ্ঠনগুলোর অর্ডার মতে শতরঞ্জিগুলো তৈরি হয়ে থাকে। তারাই সেগুলো বিদেশে পাঠিয়ে দেন। শতরঞ্জি পল্লি থেকেও করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে ভিয়েতনাম, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
তিনি জানান, কারুপণ্যে রংপুর অঞ্চলের মানুষের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ। ১০ হাজার নারী পাঁচটি কারখানায় কাজ করছে। তিনি আরও জানান, কারুপণ্যের এমডি শফিকুল ইসলাম সেলিম ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে রপ্তানিতে স্বর্ণপদক পাচ্ছেন শতরঞ্জি রপ্তানি করে।
রংপুর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সরোয়ার চৌধুরী টিটু বলেন, নগরীর নিসবেতগঞ্জ এলাকার শতরঞ্জি নামক প্রাচীন শিল্প। অবাধ বাণিজ্যে আর চরম প্রতিযোগিতার বাজারে এখানকার ঐতিহ্য শতরঞ্জি যে মর্যাদা লাভ করছে তা দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারকে সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছি।