ঘানি ভাঙা সরিষার তেল বেচে কুষ্টিয়ার মিজানের ভাগ্যবদল
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচএম আরিফ, কুষ্টিয়া
সংসারের অভাব-অনটন মেটাতে পরিবার-পরিজন ফেলে ২০১১ সালে সুদূর ওমানে পাড়ি জমান কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শেরকান্দি গ্রামের মিজানুর রহমান (৪২)। বিদেশের মাটিতে বেছে নেন ওয়েল্ডিংয়ের কাজ। শুর হয় ভাগ্যবদলের চেষ্টা। দিন-রাত হাড় ভাঙা খাটুনি খাটতেন মিজান। কিন্তু ভাগ্য খুব বেশি দিন তার সহায় হয়নি। একদিন ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে তার দুই পায়েরই গোড়ালি ভেঙে যায়। কাজ করার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ায় তাকে এক প্রকার খালি হাতেই দেশে ফিরে আসতে হয়। ২০১৯ সালে দেশে ফিরে স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে এবং বৃদ্ধা মা সব মিলিয়ে ছয় সদস্যের সংসার কীভাবে চালাবেন, এ নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় পড়েন। অবশেষে বাড়ির সঙ্গে রাস্তার ধারে ছোট্ট একটুখানি জায়গা টিন দিয়ে ঘিরে সেখানে গড়ে তোলেন হালের বলদ দিয়ে কাঠের ঘানিতে খাঁটি সরিষা ভাঙানোর পৈতৃক ব্যবসা। মিজান এন্টারপ্রাইজ নামে নিজের প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেন। ঘাড়ে ঘানি আর চোখের ওপর মোটা কাপড়ের পর্দা বেঁধে দিয়ে চলছে কলুর বলদ। কাঠের তৈরি ঘানিটা ঘুরছে আর সরিষা পিষে তা থেকে খাঁটি সরিষার তেল উৎপাদন হচ্ছে। ধীরে ধীরে টিনের পাত্রে এসে সেই সরিষার তেল জমা হচ্ছে। এভাবে শুরু হয় হালের বলদ দিয়ে বিদেশ ফেরত যুবক মিজানের খাঁটি সরিষার তেল তৈরির ব্যবসা। তেলের ঝাঁজাল গন্ধে যে কারও চোখে পানি এসে যেতে বাধ্য। অন্য কোনো কিছু না মেশানোর কারণে খুব অল্প দিনের মধ্যেই মিজানের এ কলুর বলদ দিয়ে ভাঙানো খাঁটি সরিষার তেলের কথা উপজেলা ছাড়িয়ে জেলা, এমনকি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আর মিজানকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের ভাগ্যবদলের পাশাপাশি কয়েকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে মিজানের এ ঘানি ভাঙানো কারখানায়। সূত্র জানায়, কাঠের ঘানির সাহায্যে ফোঁটা ফোঁটায় নিংড়ানো খাঁটি সরিষার তেল একসময় কুষ্টিয়াসহ সারা দেশের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে বিক্রি হতো। এ তেল বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন কলু সম্প্রদায়। তবে গ্রাম-বাংলার অতি পরিচিত দৃশ্যটি এখন খুব একটা চোখে পড়ে না। এখন বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রেই তেল ভাঙানো হয়ে থাকে। তবে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শেরকান্দি গ্রামের মিজান ঐতিহ্য ও সনাতন পদ্ধতিতে খাঁটি সরিষার তেল উৎপাদনকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে এ খাঁটি সরিষার তেল কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তিনি সরবরাহ করছেন। অনেকে আবার খাঁটি তেলের আশায় ছুটে আসছেন ঘানিতে।
খোকসা উপজেলার ওসমানপুর ইউনিয়ন থেকে মিজানের কারখানায় তেল কিনতে আসা মাজেদুল জানান, ৯০ দশক পর্যন্ত এ ঘানি ভাঙানো সরিষার তেলই মানুষ ব্যবহার করত। কিন্তু যন্ত্র অবিষ্কারের পর থেকে বলদ দিয়ে ঘানি ভাঙানো সরিষার তেল যেন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেতে বসেছে। সরিষার খাঁটি তেল কিনতেই এখানে আসা। কারখানায় বসেই কথা হয় মিজানের সঙ্গে। মিজান জানান, দেশে ফিরে এসে সামান্য টাকা, আর হালের দুটি বলদ দিয়ে শুরু করেন সরিষার তেল ভাঙানো ব্যবসা। এখন নিজের সংসারের হাল ধরতে পেরেছেন। প্রথমে দুটি বলদ গরু দিয়ে শুরু হলেও তেলের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে তিনি পাঁচটি বলদ ব্যবহার করেন এ ঘানি ভাঙার কাজে। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে মিজানের ঘানির কারখানার দরজা খোলা হয়। চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। সব সময় মিজানের এ ঘানি কারখানায় ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের ভিড় যেন লেগেই থাকে।
