কয়েক বছর আগেও প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের প্রাণ শীতলক্ষ্যার তীরে দেখা যেত দখলদারদের দৌরাত্ম্য। নদীর তীর দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ছাড়াও নদীর তীর দখল করে চলত অবৈধ বালু-পাথরসহ নানা ব্যবসা। তবে হাইকোর্টের নির্দেশে নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পাশাপাশি ওয়াকওয়ে, বৃক্ষরোপণ, ইকোপার্কে বদলে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যার তীরের দৃশ্যপট। এর আগে সিদ্ধিরগঞ্জের কাঁচপুরে ও শহরে পৌনে ৮ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। সম্প্রতি শুরু হয়েছে ১৭ কিলোমিটার ওয়াকওয়ের নির্মাণ কাজ। এ ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে একদিকে যেমন শীতলক্ষ্যার তীর সম্পূর্ণরূপে দখলমুক্ত হবে তেমনি দৃষ্টিনন্দনও হবে। এতে করে বদলে যাবে শীতলক্ষ্যার তীর। জানা গেছে, ২০০৯ সালের জুন মাসে হাইকোর্ট শীতলক্ষ্যা নদীসহ রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী চারটি নদী রক্ষায় জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএকে নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশনার পরেই ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে শীতলক্ষ্যা। এরপর নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের যৌথ উদ্যোগে শীতলক্ষ্যা নদীর কয়েক হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে। কাঁচপুর সেতুর দুই পাশে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে ৫ কিলোমিটার এলাকায় নদীর তীর রক্ষায় পাকা স্থাপনা নির্মাণ, ওয়াকওয়ে (হাঁটার চলার জন্য) নির্মাণ ও গাছ লাগানোর জন্য ১৭ কোটি টাকার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১২ সালের জুন মাসে। শেষ হয় ২০১৪ সালের জুনে। ওয়াকওয়ের সঙ্গে নদীর তীররক্ষা বাঁধও নির্মাণ করা হয়। ওয়াকওয়েটি মূলত ঢাকার ডেমরা থানার করিম জুট মিলস এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সাইলো এলাকা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের ৫নং খেয়াঘাট থেকে নিতাইগঞ্জ খালঘাট পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিন কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়। নির্মিত পৌনে ৮ কিলোমিটার ওয়াকওয়েতে হাঁটাহাঁটি ও ঘোরাফেরা করতে পারায় মহা খুশি তীরবর্তী এলাকার লোকজন। দূরদূরান্ত থেকে বিনোদনপিয়াসী লোকজনও ছুটে আসে নদীর তীরের ওয়াকওয়েতে। বিশেষ উৎসবের দিনে তিলধারণের ঠঁাঁইও যেন থাকছে না এখানে। ওয়াকওয়েতে শুধু হাঁটাচলা করা যায়। পাশে অবশ্য বসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি পাকা ঘাট।
এদিকে ২০২০ সালে শীতলক্ষ্যার উভয় তীরে সিএস জরিপ অনুযায়ী নতুন সীমানা পিলার স্থাপন কাজ শুরু হয়। শীতলক্ষ্যা নদীর নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জ-সৈয়দপুর এলাকা থেকে রূপগঞ্জের কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত ২৪০০ পিলার স্থাপন করা হবে। তবে অনেক বাধা বিঘœ পেরিয়ে এরইমধ্যে সহস্রাধিক সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে শীতলক্ষ্যায় শুরু হয়েছে ১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ। বর্তমানে নদীর তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য ভেকু দিয়ে মাটি লেভেল করা হচ্ছে।
জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুসঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়) (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১ হাজার ১৮১ কোটি ১০ লাখ ৩১ হাজার টাকা। প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ বুড়িগঙ্গায় শুরু হয় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। প্রকল্পটির ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার এবং নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যায় ১৭ কিলোমিটার। প্রকল্পের নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার এ ১৭ কিলোমিটারের নির্মাণ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা। শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে প্রিমিয়ার সিমেন্ট থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার, সুলতানা কামাল ব্রিজ এলাকায় ৩ কিলোমিটার এবং শীতলক্ষ্যার পূর্ব তীরে বন্দরে ডিআইপিটিসি থেকে আকিজ সিমেন্ট পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ওয়াকওয়ে নির্মিত হবে।
প্রকল্পের পরিচালক শাহনেওয়াজ কবির জানান, শীতলক্ষ্যার তীরের ১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ওয়াকওয়ের মধ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। যার মধ্যে নিতাইগঞ্জ খাল থেকে প্রিমিয়ার সিমেন্ট পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার, কুমুদিনী থেকে গোদনাইল সাড়ে ৪ কিলোমিটার, নেভি ডকইয়ার্ড থেকে আকিজ সিমেন্ট পর্যন্ত পৌনে ২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজের টেন্ডার হয়ে গেছে। এসব জায়গায় ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। বাকি কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন।
এদিকে এ ১৭ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণের পর থেকে বদলে যাবে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এলাকার লোকজনের জীবনযাত্রা। ওয়াকওয়ে পরিণত হবে বিনোদন কেন্দ্রে এমনটিই মনে করছেন অনেকে। ডায়াবেটিস রোগীরা ভোর হলেই ছুটে যাচ্ছেন নদীর তীরে। ওয়াকওয়ে ঘিরে জমে উঠছে ব্যবসা-বাণিজ্য। যে কারণে এ নতুন ১৭ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মিত হলে নদীর তীর ধরে শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে হেঁটে নিতাইগঞ্জ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ হয়ে ডেমরা পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারবে সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরও সম্পূর্ণরূপে দখলমুক্ত হবে।