ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

বগুড়ার তাহফিজ টুপি এখন বিশ্ববাজারে

বগুড়ার তাহফিজ টুপি এখন বিশ্ববাজারে

এখন রমজান মাস। কয়েকদিন পরেই ঈদুল ফিতর। জালি টুপির জন্য খ্যাত শেরপুর উপজেলার কারিগরদের দম ফেলার ফুরসত নেই এ সময়। সব ডিজাইনের ওপর চাহিদা থাকলেও এবার কারিগর ও ব্যবসায়ীরা বেশি তৈরি করছেন ‘তাহফিজ টুপি’। কারণ নতুন এ ডিজাইনটি ক্রেতাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে।

কারিগর ও ব্যবসায়ীরা জানান, আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিযোগী হাফেজ সালেহ আহমাদ তাকরীম একটি টুপি পরে অংশগ্রহণ করে এবং প্রথম স্থান অর্জন করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের সুনাম বয়ে এনেছেন। এরপর থেকে ‘তাহফিজ টুপি’ নামে সেই টুপিটি ভাইরাল হয়ে যায় এবং বাজারে প্রচুর চাহিদা বেড়ে যায়।

টুপি কারিগররা জানান, বগুড়ার শেরপুরের, কাশিয়াবালা, তালপুকুরিয়া, চকধলী, জয়লা-জুয়ান, জয়লা-আলাদি, কল্যাণী, চক-কল্যাণী ও গুয়াগাছী এবং ধুনটের বোহালগাছা, চৌকিবাড়ি, ফড়িংহাটা, কুড়হা-হাটা, বিশ্বহরিগাছা, চাঁনদার, ভূবনগাতি, চালাপাড়া, পাঁচথুপি, থেউকান্দি ও বাটিকাবাড়িসহ এই দুই উপজেলায় ৬০০ পরিবার এই টুপি শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

এসব এলাকায় তৈরি রকমারি টুপি দেশের সীমানা পেরিয়ে আজ সুদূর সৌদি আরব, পাকিস্তান, দুবাই, কাতার, ভারতসহ মুসলিম সব দেশেই প্রায় রপ্তানি হয়। বেশ ক’টি দেশে সুনাম কুড়িয়ে আনছে বগুড়ার শেরপুরে তৈরিকৃত জালি টুপি। এসব টুপি তৈরির সঙ্গে জড়িত ৫ লাখ নারী শ্রমিক ও শিক্ষার্থী এবং প্রায় ২০০ ব্যাপারী।

এই জালি টুপি থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বৈদেশিক অর্থ আয় হয়। সেই সাথে ওদের ভাগ্যের সঙ্গে দেশীয় অর্থনীতির চাকাও বেশ জোরোসোরেই ঘুরে। কিন্তু এ বছর সুতার দাম বেশি থাকায় চাহিদামতো উৎপাদন হচ্ছে না টুপি। টুপি ব্যবসায়ে জড়িত স্থানীয় ব্যাপারী রাজু আকন্দ জানান, ৫ লাখ নারী এ পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছে। প্রতিবারের ন্যায় এবারও ঈদকে সামনে রেখে এ পেশায় আরও কয়েক হাজার নারী-পুরুষের আগমন ঘটেছে।

গ্রামের বধূরা ঘরের কাজ শেষ করে অবসর সময়ে নানা সুখণ্ডদুঃখের আলাপচারিতা আর জমানো গল্পের আসরেই চলে তাদের রকমারি হাতের কাজ। ওদেরই নিপুণ হাতের ছোঁয়া আর সুতা ও ক্রুশ কাটা এই দু’য়ের মিলিত বন্ধনেই তৈরি হচ্ছে রং-বেরংয়ের রকমারি টুপি। এদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা নিজের হাত খরচ মজাতেও তৈরি করছে টুপি। এতে মাসে তাদের দেড় হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত এক একজন আয় করে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, খানপুর ইউনিয়নের তালপুকুরিয়া গ্রামের শানু খাতুন, আলেয়া ও মর্জিনা বিবি জানান, তারা জন্মের পর থেকেই নিজেকে টুপি বানানোর পেশার সঙ্গে যুক্ত। তাদের মতে, বাড়িতে কর্মহীন হয়ে বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করাই ভালো। এমন ভাবনা এবং বংশীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করতেই অনেকেই টুপি তৈরির শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।

ছাতিয়ানি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর মিম সুলতানাসহ সাবিনা ইয়াসমিন, সুবর্ণা ও শিউলি জানান, তারা স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি টুপি তৈরি করে। দিনে ১টি করে টুপি তৈরী করে। সেই টুপি ২৫ টাকায় বিক্রি করা হয়।

তারা আরও জানান, ৭৫ টাকার সুতা দিয়ে ৮ থেকে ৯টি টুপি তৈরি হয়। আগে যে সুতার দাম ছিল ৬০ টাকা এখন সেই সুতা ৭৫ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে তাদের।

কাশিয়াবালা গ্রামের গৃহবধূ ফরিদা পারভিন, শিউলি খাতুন, রুমি, জোৎস্না, আছিয়া, এছাড়া গ্রামের গৃহবধূরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুপি বানিয়ে থাকেন। তা থেকে আয়ও মন্দ হয় না। বিশেষ করে রমযানে গ্রামে গ্রামে টুপি তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। সবকিছু বাদ দিয়ে গৃহবধূরা টুপি তৈরির কাজ করেন। এ সময় বাড়ির অন্যরাও বাদ থাকেন না। তারা কোন না কোনভাবে ওই কাজে সহযোগিতা করেন। তারা জানান, বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সুতা দিয়ে আসেন। পরে সুতার দাম কেটে রেখে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে টুপি কেনেন।

ব্যাপারী মো. সোহাগ জানান, ঠিকমতো কাজ করলে দিনে সর্বোচ্চ ৪টি টুপি বুনানো সম্ভব। ৭০ টাকা দামের এক ববিন সুতা দিয়ে ১২টি টুপি তৈরি হয়। যার দাম ৪০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। ব্যাপারীরা বাড়িতে গিয়ে সুতার ববিন দিয়ে আসেন এবং টুপি তৈরি শেষ হলে নিজেরাই খরিদ করে থাকেন। ওইসব রকমারি টুপি বিভিন্ন মুসলিম দেশে বিক্রি হয়।

বাংলাদেশ জালি টুপি অ্যাসেসিয়েশনের বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি জুয়েল আকন্দ বলেন, প্রতি বছর প্রায় আমরা ৫০ কোটি টাকার অধিক বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনি। করোনার কারণে ব্যবসা থেমে গেলেও এবার ‘তাহফিজ টুপি’ প্রচুর চাহিদা বাজারে, আমরা এর চাহিদা মেটাতে পারছি না।

তবে আমরা সরকার থেকে কোনো অনুদান বা কোনো সহযোগিতাও পায় না। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে পাশে দাঁড়াতে হবে। তাছাড়া এই শিল্প ধ্বংস হবে। কোটি কোটি টাকা প্রতি বছর রাজস্ব খাত হতে বঞ্চিত হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত