বাতিল হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প

এডিপিতে কাটছাঁট

প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অর্থ আত্মসাতের জন্য বিনাপ্রয়োজনে বহু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। অনেক জায়গায় প্রকল্প গ্রহণ করলেও বাস্তবায়ন না করেই অর্থ আত্মসাৎ করে নেয়া হয়েছে। চলমান প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি না থাকায় অপ্রয়োজনীয় ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করে বাতিল করবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়ন সংস্থাগুলো।

জানা গেছে, চলতি বছর মোট বরাদ্দ ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম পাঁচ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন মাত্র ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। খরচ হয়েছে ৩৪ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ১৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের জন্য বরাদ্দ করা অর্থের ১০ শতাংশও খরচ করতে পারেনি। এমন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো- নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, সেতু বিভাগ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় (থোক বরাদ্দসহ), স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়। সবচেয়ে বেশি এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকল্পগুলোয়। এ বিভাগের অনুকূলে ২৩১টি প্রকল্পে ৩৭ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। জুলাই-ডিসেম্বরে তারা খরচ করেছে ৯ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ক্ষমতার পটপরিবর্তন, ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালকদের খুঁজে না পাওয়া ও সরকারের অর্থ ছাড়ে কড়াকড়ি- এসব কারণে উন্নয়ন প্রকল্পে কম টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া নতুন প্রকল্প পাসের ক্ষেত্রে কঠোর যাচাই-বাছাই করার উদ্যোগ নিয়েছেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে তিন প্রকল্পে ৩ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এসব প্রকল্পে এরই মধ্যে ৬৭৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। নেত্রকোনায় শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, যশোরে শেখ জহুরুল হক পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ও খুলনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার এই তিন প্রকল্পসহ কম অগ্রাধিকার প্রকল্প বাতিল করা হচ্ছে। বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্প এবং সরকারি অর্থায়নে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাদ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে সরকারের সামগ্রিক অগ্রগতির পরিকল্পনায় নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

অপ্রয়োজনীয় ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত প্রকল্পগুলো বাদ পড়েছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। অর্থাৎ আরো প্রকল্প বাদ পড়তে পারে। বরাদ্দ কমতে পারে। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে সরকার পরিবর্তন এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ধাক্কা লেগেছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত গত পাঁচ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়নের হার গত ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এমন বাস্তবতায় এডিপির আকার ছোট করে আনা হচ্ছে। মূল এডিপি থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। এতে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা আরএডিপির আকার দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর মূল এডিপির আকার ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ধরা হয় ১ লাখ কোটি টাকা। জিওবি বা সরকারি তহবিল থেকে রয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাকিটা বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন। শিগগির আরএডিপি-সংক্রান্ত খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। এরপর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) তা অনুমোদনের জন্য তোলা হবে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব এডিপি বাস্তবায়নে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে নতুন গতিতে ফিরিয়ে আনতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এডিপিতে সরকারের নিজস্ব জোগান এবং বিদেশি ঋণ দুই উৎসের অর্থই কমানো হচ্ছে। নিজস্ব জোগান থেকে পরিমাণে বেশি কমানো হচ্ছে। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা কমনো হচ্ছে এ অংশের অর্থ বরাদ্দ। এতে আরএডিপিতে সরকারের নিজস্ব জোগানের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে আরএডিপিতে বিদেশি ঋণের উৎস থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা কমানো হচ্ছে। এতে বিদেশি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৮১ হাজার কোটি টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয়গুলোর কাছ থেকে পাওয়া সংশোধিত চাহিদার ভিত্তিতে আরএডিপির খসড়া তৈরি করেছেন তারা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে সময় পাওয়ার পর এনইসি বৈঠকের তারিখ ঠিক করা হবে। তিনি জানান, চলতি অর্থবছর মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলো থেকে চাহিদা কম পাওয়া গেছে। এর বড় কারণ হিসেবে প্রকল্প পর্যালোচনার কথা উল্লেখ করেন তিনি। গত অর্থবছর মূল এডিপি থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে আরএডিপি চূড়ান্ত হয়। মূল এডিপিতে কাটছাঁট হয় ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এতে আরএডিপির আকার ২ লাখ ৭৫ কোটিতে নেমে আসে। ওই বছর মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং সরকার সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি। আবার, অপ্রয়োজনীয় ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করে স্থগিত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, জনগণের প্রকৃত চাহিদা ও সরকারের বাস্তবায়ন সক্ষমতা যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল। অনেক প্রকল্পে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে প্রকল্প অনুমোদন ও তহবিল প্রাপ্তি সহজ করা হয়েছিল, যা জনগণের সম্পদের সদ্ব্যবহারের সুযোগকে নষ্ট করেছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করে বাতিল করা এবং এগুলোর সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান ড. মুজেরী।

চলতি অর্থবছরের এডিপিতে কাটছাঁটের ছোঁয়া লাগেনি বড় বরাদ্দ পাওয়া এলজিইডি ও বিদ্যুৎ খাতে। বরাবরের মতো উন্নয়ন আরেকটু পিছিয়ে পড়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে, যেখানে গতানুগতিক হোঁচট যেন থামতে চায় না। পাঁচ মাসে স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো এক টাকাও খরচ করতে পারেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৩টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা, তবে তা পুরোপুরি অব্যবহৃত রয়েছে। একইভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাদ্দকৃত ১৪৩ কোটি টাকার এক পয়সাও ব্যয় করতে পারেনি। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের বরাদ্দ কাটছাঁটের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মূল এডিপিতে সওজের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৮২ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে ১১ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা কমানো হচ্ছে। এ ছাড়া বিআরটিসির প্রায় পুরো বরাদ্দ কেটে নেয়া হচ্ছে, যদিও ডিটিসিএর বরাদ্দ অপরিবর্তিত থাকছে। সওজ জানিয়েছে, ভূমি অধিগ্রহণে সমস্যা, টেন্ডার প্রক্রিয়ার বিলম্ব ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে প্রকল্পগুলো এগোতে পারছে না। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো এডিপি বাস্তবায়নে চরম ব্যর্থ হয়েছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চলতি অর্থবছরে প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করা জরুরি। এতে অর্থনীতির গতির সম্পর্ক আছে। আগে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেয়া হতো। অর্থায়ন না করে বসিয়ে রাখা হতো। এতে ব্যয় ও খরচ বেড়ে যায়। প্রকল্পের সংখ্যা কমলেও বিদ্যমানগুলো বাস্তবায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হলে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। যেগুলো আছে সেগুলো সুশাসনের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, অনেক প্রকল্প রাজনীতিক বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। অর্থায়নের নিশ্চয়তা দেখা হয়নি। সুতরাং এডিপি থেকে এসব প্রকল্প কমলেও বড় ধরনের সমস্যা হবে না। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি বলেন, বাজেট ঘাটতি সহনীয় রেখে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সংশোধনের কাজ করছি। উন্নয়ন বাজেটের আকার ছোট হলেও প্রবৃদ্ধি কমবে না। আমাদের লক্ষ্য কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং জনগণের উপকার করা। মানুষের কল্যাণে আছে ও কর্মসংস্থান বাড়বে এমন প্রকল্প বেশি বাস্তবায়ন করা হবে।