
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরও পুলিশের নির্মমতা থেমে থাকেনি। ২০২৪-এর ৫ আগস্ট বিকাল তখন আনুমানিক ৪টা। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা যখন গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সারা দেশে বিজয়োল্লাস করছিল, তখনও বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বর্বরতা চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরা পূর্ব থানার সামনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান নাজিম উদ্দিন।
নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার চিরাম ইউনিয়নের ভাটগাঁও গ্রামের রোস্তম আলী ও শিমুলা আক্তারের একমাত্র ছেলে সন্তান নাজিম উদ্দিন আঠারো বছর বয়সি এক টগবগে যুবক। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে শ্রমিক বাবার কষ্ট লাঘব করার। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভর্তি হয়েছিলেন বারহাট্টা সরকারি কলেজে। নাজিমের বাবা-মা ঢাকায় থাকতেন। মা শিমুলা আক্তার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। বাবা শ্রমিক। একমাত্র বড় বোন নাজমার বিয়ে হয়ে গেছে, স্বামী-সন্তান নিয়ে টঙ্গীতে থাকেন। নাজমার একটি মেয়ে রয়েছে, নাম আসফিয়া।
নাজিমের মা-বাবা ঢাকায় থেকে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। পাশাপাশি চিন্তিত ছিলেন ছেলে নাজিমের পড়াশোনা নিয়েও। ভেবেছিলেন নাজিমকে বারহাট্টায় তার নানাবাড়িতে রেখে পড়াশোনা করাবেন। সে চিন্তা থেকেই নাজিম বারহাট্টা সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে কলেজে ভর্তি হয়ে নাজিম ঢাকায় ফিরে যান। সম্পৃক্ত হন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। নেমে আসেন রাজপথে। শোষণ, বৈষম্য আর ফ্যাসিবাদী স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশ-মাটি-মা আর দেশের মানুষকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে শেষপর্যন্ত রাজপথে নিজের তাজা রক্ত ঢেলে শহিদ হন।
৫ আগস্ট দুপুর বেলা নাজিম মা-বাবার সঙ্গে ঢাকার ভাড়া বাসায় ছিলেন। বাইরে কাজে যেতে না পেরে বাসায় বসে টেলিভিশনে দেশের খবর নিচ্ছিলেন। শেখ হাসিনার পলায়নের সংবাদে বিজয়োল্লাস করার জন্যে যখন সারাদেশের মানুষ রাজপথে নেমে আসে, তখন নাজিমও সে বিজয়োৎসবে অংশগ্রহণ করেন। নাজিমের ফোনের ভিডিও থেকে দেখা যায়, পলাইছেরে পলাইছে, শেখ হাসিনা পলাইছে বলে নাজিম বন্ধুদের সঙ্গে বিজয় মিছিলে নেমে ঢাকার উত্তরার পূর্ব থানার সামনে স্লোগান দিচ্ছিলেন।
হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর দেশ ফ্যাসিস্ট মুক্ত হলেও তার দোসররা তখনি থেমে যায়নি। তারা সর্বশেষ মরণ কামড় দিয়েছে। নাজিমসহ আন্দোলনের সহযোদ্ধারা যখন হাসিনাবিরোধী স্লোগান দিচ্ছিল ঠিক তখনি পুলিশ গুলি করে। নাজিমের চোখের নিচ দিয়ে বুলেট একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশে বের হয়ে যায়। সহযোদ্ধারা তাকে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একমাত্র আদরের ছেলেকে হারিয়ে মা শিমুলা আক্তার পাগলপ্রায়। নাজিমকে হারিয়ে যেন সব হারিয়ে ফেলেছেন তার মা-বাবা বোন, ভাগ্নে সবাই। শহিদ নাজিমের বোন নাজমা কাদতে কাঁদতে বলেন, একটাই তো ভাই ছিল আমার, এখন কাকে ভাই বলে ডাকবো?
তিনি বলেন, দেশটা এখনও ঠিকঠাক হয়নি, আমাদের কোনো প্রত্যাশা নাই, আমরা চাই আমাদের মতো আর কোনো পরিবারকে যেন এমন দিন দেখতে না হয়। ভাইয়ের হত্যার বিচারটা যেন হয়। শহিদ নাজিমের পরিবার জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন, উপজেলা পরিষদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, নাজিমের স্কুলের বন্ধুরাসহ বেশ কিছু জায়গা থেকে অনুদান, সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন। মা শিমুলা আক্তার আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, আমার পুতরে কতোদিন ধইরা দেখি না! আমার পুত কই? এখন কেলা আমারে আম্মা বইলা ডাকবো?
তিনি অভিযোগ করেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে যেসকল আর্থিক সাহায্য, সহযোগিতা পেয়েছেন তা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে অনেকে ষড়যন্ত্র করছে। নাজিমের বাবা সহজ-সরল মানুষ, কানে কম শোনেন। আশপাশের অনেকে তাকে দিয়ে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্যে। শহিদ নাজিমকে নিজ বাড়ির আঙিনায় দাফন করা হয়েছে। বর্ষায় ঝুম বৃষ্টিতে সিক্ত হচ্ছে হাওরপারের সন্তান শহিদ নাজিমের কবর।