না.গঞ্জে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা একবছরে বন্ধ ৬৪ কারখানা

* কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী * সমন্বিত সেবার অভাব, ওয়ানস্টপ সার্ভিসের দাবি

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মোশতাক আহমেদ শাওন, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানাগুলোয় অস্থিরতা বেড়েছে। গত এক বছরে পোশাক শিল্পে সমন্বিত সেবার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার, শিল্পকারখানায় গ্যাসের তীব্র সংকট, শ্রমিকদের আন্দোলন, বিদেশি বায়ার না পাওয়া, আর্থিক সংকট ও বিভিন্ন সিন্ডিকেটের কারণে ছোট-বড় ও মাঝারি মিলিয়ে কমপক্ষে ৬৪টি তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী।

নারায়ণগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ-৪ এর তথ্যে দেখা যায় জেলায় মোট কারখানা ১৮৩৪টি। এরমধ্যে আরএমজি ৪২৪টি ও নন-আরএমজি ১৪১০টি। জুলাই বিপ্লবের পর থেকে এক বছরে ৪০টি তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অস্থায়ীভাবে আরও বন্ধ রয়েছে ২০টি। লে-অফ হয়েছে ২টি ও ১৩(১) ধারায় ১টি। পোশাক কারখানার কর্তৃপক্ষরা বলছেন, নানা সমস্যা মোকাবিলা করলেও পোশাক অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও শ্রমিক আন্দোলনের কারণে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক শিপমেন্ট বাতিল হচ্ছে। এরফলে বাধ্য হয়ে করাখানা বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।

অন্যদিকে শিল্পপতিদের অভিযোগ, সমন্বিত সেবার অভাবে পোশাক শিল্প মেরুদণ্ড সোজা করে দাড়াতে পারছে না। প্রতিটি দপ্তরে আলাদা আলাদা অনুুমোদন নিতে হয়। এতে সময় ও খরচ বেড়ে যায়, ফলে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে উৎপাদন ও রপ্তানি পক্রিয়া। রপ্তানির লক্ষ্যে পৌঁছাতে উৎপাদন, আমদানি-রপ্তারি ও বাজার সম্প্রসারণ সব ধাপে প্রয়োজন সমন্বিত ও দ্রুত সেবা। এ সমম্যা থেকে পরিত্রান পেতে তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ওয়ার স্টপ সার্ভিস। কিন্তু সব সরকারই এ ব্যাপারে উদাসিন। অ্যাসরোটেক্স গার্মেন্টের মালিক আসাদুল ইসলাম বলেন, আমি লাভবান না হলেও কোনো মাসে শ্রমিকদের বেতনভাতা দেরিতে দিইনি। এরপরও শ্রমিকদের তুচ্ছ দাবিতে আন্দোলনের কারণে বিদেশি বায়াররা ভয়ে সরে গেছেন। এখন ইচ্ছা করলেই কারখানা খোলা সম্ভব নয়।

এএসটি গার্মেন্টের মালিক আতিকুর রহমান বলেন, অর্ডার কমে যাওয়ার পাশাপাশি আর্থিক সংকটে কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভর্তুকি দিয়ে কয়েক মাস কারখানাটি চালানো হয়। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি এমএ শাহীন জানান, বন্ধ কারখানার বেশিরভাগ শ্রমিক বেঁচে থাকার জন্য এখন অটোরিকশা চালাচ্ছেন। কিছু শ্রমিক গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। আবার কিছু সংখ্যক শ্রমিক দিনমজুরের পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। গার্মেন্টস শিল্পের বর্তমান সংকট বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি এমএ হাতেম জানান, মূলত তিনটি কারণে বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্প ধুকছে। মালিকপক্ষ ও শ্রমিক পক্ষ উভয়েই চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তিনটি মূল কারণের মধ্যে প্রথম কারনটি হচ্ছে ব্যাংকিং সংকট। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দোহাই দিয়ে ও তাদের নানা কারণ দেখিয়ে যখন তখন গার্মেন্টস এর সঙ্গে সব প্রকার আর্থিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া। এতেকরে এলসি খুলতে সমস্যা। ব্যাক টু ব্যাক এলসি করা যায়না। এলসি করে পেমেন্ট মিলে না। একটি কারখানা একমাসের জন্য ক্লাসিফায়েড হিসেবে চিহ্নিত হলে তার সবশেষ। এক মাসের লোকসানে মালিক পথে বসে যায়।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, কিছু বায়ারদের ‘আন ইথিক্যাল বায়িং প্র্যাকিটিস’। আমেরিকা, ইউরোপ ও ইতালীতে বাংলাদেশি অধিকাংশ বায়ার এখন টাউট-বাটপারি শুরু করেছে। তারা সময়মত পেমেন্ট দেয় না। আমেরিকাতে বাংলাদেশি বায়ারদের অধিকাংশই টাউট-বাটপারি শুরু করেছেন। তৃতীয় কারণটি হচ্ছে, গ্যাংস সংকট। সময় মতো গার্মেন্টস কারখানা উৎপাদন করতে পারে না। শীপমেন্ট ও দিতে পারে না। পেমেন্ট আসবে কোথা থেকে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-মহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র ঘোষ বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে সবসময় চেষ্টা থাকে কোনো কারখানা যেন স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে না যায়। এতে অনেক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন।

পোশাক কারখানা বন্ধের বিষয়ে শিল্পাঞ্চল পুলিশ-৪ নারায়ণগঞ্জ জোনের পরিদর্শক (গোয়েন্দা) সেলিম বাদশা বলেন, এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। তবে বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি অনেক কারখানা নতুন করে উৎপাদনে গেছে। কোনো কোনো কারখানায় কাজের চাপ কম রয়েছে। এদিকে, বায়ার না পাওয়া, আর্থিক সংকট ও বিভিন্ন সিন্ডিকেটের কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু। তিনি বলেন, কিছু মালিক পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তারাও আত্মগোপনে চলে গেছেন। এসব সমস্যার কারণে লাস্ট কয়েক মাসে নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।

এতে একজন শ্রমিক বেকার হওয়ার পাশাপাশি তার পরিবারের সদস্যরাও সমস্যার মুখে পড়েছেন। সরকারের উচিত, বাইরে থেকে যে শক্তিগুলো শিল্প-কলকারখানা বন্ধ করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থানে যাওয়া।