নেপালে সহিংসতার পেছনে ষড়যন্ত্র দেখছেন প্রধানমন্ত্রী
* পার্লামেন্ট পুনর্বহালের দাবি প্রধান দলগুলোর * বিক্ষোভে নিহত বেড়ে ৭২
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
নেপালে আন্দোলন থেকে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা বৃহত্তর কোনও ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন নবনিযুক্ত অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ধ্বংসযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
গতকাল রোবাবার সিংহ দরবারে নিজের নতুন কার্যালয়ের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে নেওয়ার সময় জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী কার্কি এসব কথা বলেন। নেপালের ইতিহাসে এমন ভয়াবহ মাত্রার ধ্বংসযজ্ঞ দেখা যায়নি উল্লেখ করে কার্কি বলেন, এসবের পেছনে আসলেই যদি নেপালিরা জড়িত থাকেন, তাহলে আমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। তবে এটা কোনও বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে পরিস্থিতিতে গঠিত হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা সবাই অবগত আছি। গত কয়েক দিনে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য-আলামত ধ্বংস করা হয়েছে। সরকারি বাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে হামলা চালানো হয়েছে। এসব ঘটনার অবশ্যই বিচার করা হবে। দোষীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে। পরিস্থিতির ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরে মুখ্য সচিব একনারায়ণ আচার্য বলেন, সরকারি কার্যালয় ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তিনি দ্রুত পুনর্গঠন তহবিল বরাদ্দ ও জরুরি সেবা পুনঃস্থাপনের ওপর জোর দেন।
পুনর্গঠন কার্যক্রমে স্বনির্ভরতার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্কি বলেন, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্র্নিমাণ দেশের নিজস্ব সম্পদ দিয়েই করতে হবে। গতকাল মহারাজগঞ্জে গিয়ে শুনলাম স্থানীয় ব্যবসায়ীরা থানা পুনর্র্নিমাণের অঙ্গীকার করেছেন। আমি তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি। সমালোচনার বদলে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে চলুন, আমরা সামনে এগোই। আমাকে এ কাজে সহায়তা করুন।
নেপালে দুর্নীতি দমন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক সমতা নিশ্চিত করতে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এটাই দেশের তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা। তিনি আরও বলেন, ক্ষমতা উপভোগ নয়। বরং তরুণ প্রজন্মের সঁপে দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে শপথ গ্রহণ করেছি, বলেন নেপালের নবনিযুক্ত অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কি। এ সময়, আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করে নতুন পার্লামেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার পুনরায় ব্যক্ত করেন তিনি। এদিকে দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল নেপালে দেখা দিয়েছে নতুন সংকট। বিক্ষোভণ্ডসহিংসতার জেরে ভেঙে দেওয়া পার্লামেন্ট পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে দেশটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো।
এমনকি পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপকে তারা অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছে। গত শনিবার রাতে এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, নেপালের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউডেলকে ভেঙে দেওয়া পার্লামেন্ট পুনর্বহালের আহ্বান জানিয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভের জেরে তিনি সম্প্রতি পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
গত শনিবার দেওয়া এক যৌথ বিবৃতিতে নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন-ইউএমএল, মাওবাদী কেন্দ্রসহ আটটি দল অভিযোগ করেছে, প্রেসিডেন্টের এই পদক্ষেপ অসাংবিধানিক। এর আগে গত শুক্রবার নবনিযুক্ত অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কির পরামর্শে আইনসভা ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট। মূলত এটি ছিল বিক্ষোভকারীদেরও প্রধান দাবি।
এর আগে গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এতে দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন নিহত হন। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার পর ৭৩ বছর বয়সী সাবেক প্রধান বিচারপতি কার্কিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়।
মূলত নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর সোমবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হলেও ততক্ষণে বিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গত মঙ্গলবার ক্ষুব্ধ জনতা কাঠমান্ডুর পার্লামেন্ট ভবন ও সরকারি দপ্তরে আগুন ধরিয়ে দেয়, বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি।
এমন অবস্থায় শনিবারের বিবৃতিতে আট দল পার্লামেন্ট পুনর্বহালের দাবি জানায়। তাদের অভিযোগ, প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপ নেপালের আদালতের রায়ের দৃষ্টান্তেরও পরিপন্থি।
তবে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া ছিল তথাকথিত “জেন জি” আন্দোলনের অন্যতম দাবি। ইতোমধ্যেই আগামী ৫ মার্চ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আট দলের মতে, এসব দাবি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত।
এদিকে শনিবার প্রেসিডেন্ট পাউডেল সব পক্ষকে সংযম দেখাতে এবং নির্বাচনের আয়োজন সফল করতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “অত্যন্ত কঠিন ও ভীতিকর পরিস্থিতিতেও শান্তিপূর্ণ সমাধান এগিয়ে আসছে। সংবিধান টিকে আছে, সংসদীয় ব্যবস্থা টিকে আছে এবং ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রও টিকে আছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে আরও কার্যকর গণতন্ত্রের পথে এগোনোর সুযোগ আছে।”
নেপালের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্কি শনিবার কাঠমান্ডুতে শপথ নেন। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি মন্ত্রিসভা গঠন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। দুর্নীতিমুক্ত ভাবমূর্তির অধিকারী কার্কির নেতৃত্বকে “জেন জি” আন্দোলনের নেতারাও সমর্থন জানাচ্ছেন।
তবে তার সরকারকে একাধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর হওয়া পার্লামেন্ট ও সরকারি ভবনগুলো পুনর্র্নিমাণ, পরিবর্তনের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামা তরুণদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং গণতন্ত্র নিয়ে শঙ্কিত নাগরিকদের আশ্বস্ত করা। পাশাপাশি সহিংসতার দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করাও হবে অন্যতম দায়িত্ব।
বিবিসি বলছে, গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অস্থিরতার পর নেপাল ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে। কার্কি শপথ নেওয়ার পর সেনারা কাঠমান্ডুর রাস্তায় টহল শেষ করে ব্যারাকে ফিরে গেছে।
নেপালে সম্প্রতি সংঘটিত জেনজি বিক্ষোভে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২। দেশব্যাপী বিভিন্ন হাসপাতালে এবং চিকিৎসা কেন্দ্রে বর্তমানে আরও ১৯১ জন আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে সরকারী সূত্রে জানা গেছে।
সরকারি প্রতিনিধির বরাতে সংবাদ মাধ্যম নেপাল নিউজ জানিয়েছে, নিহতরা সেপ্টেম্বরের ৮ এবং ৯ তারিখে বিক্ষোভ চলাকালে গুরুতর আহত হন।সহিংস বিক্ষোভে কাঠমান্ডু সহ অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে মূলত জেন-জেড যুব আন্দোলনের ছাত্র ও কর্মীরা অংশ নেন। বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবন, সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট, প্রসিকিউটরের অফিসে অগ্নিসংযোগ চালায় এবং রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের বাড়িতে হামলা চালায়?
