বাবা-মায়ের কবরেই চিরনিদ্রায় ফরিদা পারভীন
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

বর্ণাঢ্য সংগীতজীবনের অধিকারী, লোকসংগীতের কিংবদন্তি এবং লালনসংগীতের সুর সম্রাজ্ঞী শিল্পী ফরিদা পারভীনকে গতকাল রোববার বাদ এশা কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থানে মা-বাবার কবরে দাফন করা হয়েছে। মা-বাবার কোলেই ফিরে গেলেন এই কিংবদন্তি লালনসংগীতের সুর সম্রাজ্ঞী শিল্পী। বিকালে ঢাকা থেকে সড়কপথে তার লাশ নিয়ে লাশবাহী গাড়ি রওনা দিয়ে রাত সোয়া ৮টায় পৌঁছায় কুষ্টিয়পিটিআই রোড়ের নিজ বাসভবনে। কিছুক্ষণ তার লাশ রাখা হয় সেখানে। এই কিংবদন্তি লালন সঙ্গীতের সুর সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুর খবরে সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত কুষ্টিয়ার আপামর জনগণ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। প্রিয়শিল্পীকে শেষবারের মতো একনজর দেখার জন্য বৃষ্টিভেজা রাত উপেক্ষা করে ভিড় জমান পিটিআই সড়কের শিল্পীর নিজ বাসভবনে। পূর্ব ঘোষণা অনুয়ায়ী কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠে বাদ মাগরিবের জানাজা হওয়ার কথা থাকলেও লাশ পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় স্থান পরিবর্তন করে কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থা?ন জামে মসজিদে জানাজা শেষে বাদ এশা তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থা?নে মা রৌফা বেগম ও বাবা দেলোয়ার হোসেনের কবরেই দাফন করা হয়েছে।
গত শনিবার রাতে রাজধানীর এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফদা পারভীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৭৩ বছর। তার মৃত্যুতে কুষ্টিয়ার বাড়িতে ভিড় জমেছে স্বজন, বন্ধু ও ভক্তদের। চারদিকে শোকের ছায়া। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি এবং নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। সপ্তাহে দু’দিন তার ডায়ালাইসিস করা হতো, আর অবশেষে চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে সংগীতাঙ্গনের শূন্যতা রেখে চিরতরে চলে গেলেন তিনি। প্রসঙ্গত, ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্মানো ফরিদা পারভীনের সংগীতজীবন শুরু হয় ১৯৬৮ সালে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে। বাবার সংগীতপ্রীতি ও পারিবারিক পরিবেশে তার গানের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হয়, যা শৈশব থেকে মাগুরায় ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে প্রথম হাতেখড়ি নেওয়া দিয়ে শুরু। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও সংগীতচর্চা অব্যাহত রাখেন ফরিদা এবং শুরুতে নজরুলসংগীত ও আধুনিক গান দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় কুষ্টিয়ায় বেড়ে ওঠা। জন্ম নাটোর হলেও, ফরিদা পারভীনের বড় হওয়া, লেখাপড়া এবং সংগীতের অন্তরঙ্গ চর্চা মূলত কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইয়ের আখড়ার প্রাঙ্গণে। তিনি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে স?াতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এখানকার বাউল, ফকিরদের সঙ্গে সংগীতের দর্শন ও অনুশীলনে যুক্ত হন। কুষ্টিয়াতে পারিবারিক বন্ধু মোকছেদ আলী সাঁইয়ের অনুপ্রেরণায় তিনি লালনসংগীতের দিকে আকৃষ্ট হন এবং এখানকার আখড়ায় গান শেখার মধ্যেই তার সংগীতজীবনের মূলস্বর?প খুঁজে পান। তার গানে, কণ্ঠে, দর্শনে ও জীবনদর্শনে কুষ্টিয়ার ভূমি ও সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট।
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠেই লালনসংগীতের এই বর্ণাঢ্য ভ্রমণ দেশজুড়ে কুষ্টিয়া ও লালনের দর্শনকে পরিচয় দিয়েছে বিশ্ব দরবারে। শিল্পীজীবনের জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি মূলত লালন সাঁইয়ের গানের মাধ্যমে। ‘সত্য বল সুপথে চল’ এই গান দিয়ে শুরু, ক্রমে লালনের আধ্যাত্মিক দর্শনে ডুবে যান তিনি। লালনের গানের ভাব, দর্শন ও বাণী তাকে নতুনভাবে চিনিয়ে দেয়। তার কণ্ঠে “খাঁচার ভিতর”, “বাড়ির কাছে আরশি নগর”সহ অসংখ্য জনপ্রিয় লালনগীতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে বিশ্বে। ফরিদা পারভীন সুইডেন, জাপান, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশে লালনসংগীত পরিবেশন করেন।
১৯৮৭ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ২০০৮ সালে জাপানের ফুকুওয়াকা পুরস্কারসহ বহু আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সম্মাননা লাভ করেন তিনি। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে “তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম”, “এই পদ্মা এই মেঘনা”, “নিন্দার কাঁটা” সহ অসংখ্য আধুনিক ও লালনগীতি বিশেষভাবে এখনও সমাদৃত।
