সুসংবাদ প্রতিদিন
কুষ্টিয়ায় হাঁস পালনে ফিরছে সচ্ছলতা
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এ.এইচ.এম. আরিফ, কুষ্টিয়া

খোলামেলা পরিবেশে খামার তৈরি করে সেখানে হাঁস পালন করে সফল হয়েছেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা ইউনিয়নের কুশাবাড়িয়ার দুই ভাই বাদশা ও বাদল। উন্মুক্ত অথচ আবদ্ধ, এই পদ্ধতির খামার তৈরি করে সেখানে হাঁস পালন করায় খরচও হচ্ছে তুলনামূলক অনেক কম। ফলে আর্থিকভাবে তারা বেশি লাভবান হচ্ছেন। হাঁস পোকাণ্ডমাকড় ও ক্ষতিকর আগাছা খেয়ে ফেলায় জমির উপকার হচ্ছে, বাড়াচ্ছে জমির উর্বরতা।
প্রায় ২০ বছর আগে বাদশার গোটা কুড়ি হাঁস নিয়ে ফাঁকা মাঠের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে জিকে ক্যানেল পাড়ের বাঁশের বাতা আর প্লাস্টিকের নেট দিয়ে তৈরি হাঁসের খামারের যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে তার এ খামারে ৫৫০টি খাকি ক্যাম্বেল জাতের হাঁস রয়েছে। মাঠের মধ্যে খোলামেলা ঘর হওয়ার কারণে বিদ্যুতের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। খামারের দুর্গন্ধও যায় না লোকালয়ে। সারাদিন হাঁসগুলোকে মাঠে চরানোর কারণে বাড়তি খাবার দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। ফলে কোন খরচ হয় না বলে জানান বাদশা। খোলামেলা পরিবেশের কারণে হাঁসের রোগবালাইও বেশ কম হয়।
খামারি বাদশা বলেন, ‘আমি প্রায় ২৪ বছর ধরে এভাবে মাঠে চরিয়ে হাঁস পালন করি। একসময় আমার বাবা এই হাঁস মাঠে চরাতেন। তার সাথে আমিও যেতাম। বাবার মৃত্যুর পর এখন নিজেই খামার করেছি’। তিনি বলেন, ‘এবছর আমার খামারে ৫৫০টি খাকি ক্যাম্বেল জাতের হাঁস রয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস পালন করেছি। তবে ইউটিউবে আমি দেখি যে, খাকি ক্যাম্বেল জাতের হাঁস বেশি ডিম দেয়। এজন্য এবার আমি এক দিনের বাচ্চা নিয়ে এসেছিলাম’। বাদশা বলেন, ‘প্রতি বছরই আমার এক থেকে দুই হাজার করে হাঁস থাকে। বছরে প্রায় ৯ মাস ধরেই এ হাঁস ডিম দেয়। আমার খামারে প্রথম ডিম দেওয়া শুরু করেছে। প্রতিদিন সকালে প্রথম কাজ আগে হাঁসের ঘর থেকে ডিম গোছানো। তারপর সকালে হাঁস বের করি, সারাদিন মাঠে চরাই’।
তিনি জানান, হাঁসগুলো ক্যানেলের ছোটছোট মাছ, শামুক, ছোট ব্যাঙ, পোকামাকড়ক খায়। জমি থেকে ধান কাটার পর নাড়ার মধ্যে পড়ে থাকা ধান খায়। বিকেল ৫টার দিকে হাঁসগুলোকে ঘরে তুলে দেন। এজন্য সারাদিন কোনো খাবার দিতে হয় না। আর যদি এভাবে না চরাতেন তাহলে দিনে ৭০ থেকে ৮০ কেজি ধান লাগতো বলে জানান এই খামারি। তিনি আরও বলেন, মাঠের মধ্যে বাঁশের খুঁটি, বেড়া এবং তার ও প্লাস্টিকের নেট দিয়ে চারপাশ ঘিরে দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে। যাতে আলো-বাতাশ ঠিকমতো ঢুকতে পারে। কোন বিদ্যুৎ বা অন্য কিছুর খরচ নেই। এছাড়া, লোকালয় থেকে দূরে হওয়ায় দুর্গন্ধও হয় না।
ক্যাম্বেল জাতের হাঁসের পালকের রং খাকি, মাথা এবং ঘাড় ব্রোঞ্জ রঙের, পা ও পায়ের পাতার রং হাঁসার হলুদ, হাঁসির কালো। ঠোটের রং হাঁসা নীলাভ, হাঁসি কালো। খাকি ক্যাম্বেল জাতের হাঁস বেশি কষ্ট করতে পারে। একটানা ১-৩ বছর পর্যন্ত ডিম পাড়ে। বছরে প্রায় ২৫০-৩০০টি ডিম দেয়। খোলা খাকি ক্যাম্বেল হাঁস পালন করা যায়।
তিনি বলেন, খোলা অবস্থায় এভাবে মাঠে চরিয়ে হাঁস পালন করা অধিক লাভ। তবে খুবই সতর্ক থাকতে হবে রোগবালাই এর ব্যাপারে। কারণ খামারে একটা হাঁসের রোগ হলে অন্য হাঁসেরও রোগ হতে পারে। এরইমধ্যে ছোট থেকে বড় করতে মোট ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। এখন বিক্রি করলেও আড়াই লাখ টাকা শুধু হাঁসই বিক্রি হবে। ডিম বিক্রি করেই খরচ উঠে যায়।
বাদশার ছোট ভাই বাদলও একই পদ্ধতিতে হাঁস পালন করেন। এই প্রাকৃতিক পদ্ধতির কারণে রোগবালাইও অনেক কম হয়। তার খামারে ১৬০টি হাঁসের মধ্যে প্রতিদিন ১৩০-১৪০টি করে ডিম দেয়। বাদশা জানান, তার খামার থেকে প্রতিদিন ১৮০০ থেকে ২০০০ হাজার টাকা আসে। তিন মাস ধরে ডিম পাচ্ছেন। আরো ছয় মাস এভাবে ডিম পাবেন বলে আশা বাদলের।
স্থানীয় কৃষক কাশেম আলী বলেন, ‘মাঠে আসার সময় প্রায়ই দেখি ক্যানেলের মধ্যে হাঁসগুলো খেলা করছে। দেখতে বেশ ভালো লাগে। এছাড়া মাঠের মধ্যে পোকামাকড়, খুদে পানা এবং আগাছা খেয়ে ফেলে হাঁস। সেই সাথে মাঠে পায়খানা করার কারণে জমির উর্বরতাও বৃদ্ধি পায়’।
স্থানীয় যুবক মামুন হোসেন জানান, ‘এভাবে মাঠে কম খরচে হাঁসপালন করা যায় তা বাদশাকে না দেখলে জানতাম না। সরকার যদি আমাদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সুবিধা দিয়ে হাঁস পালনে উৎসাহ দিত তাহলে অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো’।
মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ধান কাটার পরে জমিতে পোকামাকড় আশ্রয় নেয়। মাঠে হাঁস চরালে তারা পোকা ধরে খায়। এছাড়া ক্ষতিকর আগাছা ধ্বংস করে হাঁস। হাঁসের বিষ্ঠা জমির উর্বরতা বাড়ায় এবং প্রাকৃতিক সার হিসাবে কাজ করে, যা ফসলের জন্য উপকারী।
মিরপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার আব্দুল্লাহিল কাফি জানান, খাঁকি ক্যাম্বেইল হাঁস ডিম উৎপাদনের জন্য বেশ জনপ্রিয়। আবদ্ধ এবং মুক্ত আবদ্ধ পদ্ধতিতে এ জাতের হাঁস পালন করা লাভজনক। দিনের বেলা খাল-বিল-মাঠে চরিয়ে রাতে ঘরে রেখে লালন-পালন করলে হাঁসের উৎপাদন খরচ কম হয়। বাড়তি খাবারের প্রয়োজন হয় না। তারা খামারিদের বিভিন্ন সময়ে হাঁস পালনে পরামর্শসহ সহযোগিতা করেন বলে জানান এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।
