পোষ্য কোটা ফিরিয়ে আনাকে রাকসু বানচালের ষড়যন্ত্র বলছেন প্রার্থীরা
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাবি প্রতিনিধি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে পোষ্য কোটা। গত বৃহস্পতিবার ১০টি শর্তে এই কোটা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় ভর্তি উপকমিটি। সিদ্ধান্তটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের পরপর আবারও প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। নতুন কর্মসূচি অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের ডাক দেন তাঁরা। অনেকেই এটিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাকসু, হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন। এসব নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে পোষ্য কোটা ফেরানো হয়েছে। অথচ এর আগে বিষয়টি নিয়ে তীব্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রশাসন ভবনে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবরুদ্ধ করা হয়, প্যারিস রোডের পাশে পোষ্য কোটার প্রতীকী কবর দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পোষ্য কোটা বাতিল ঘোষণা করেন উপাচার্য সালেহ্ হাসান নকীব। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পোষ্য কোটা থাকবে না বলে তিনি জানিয়েছিলেন।
এরপর পোষ্য কোটা পুনর্বহালের দাবিতে কয়েক দফা আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সিনেট ভবনে ভর্তি উপকমিটির এক সভায় স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য ১০টি শর্তে পোষ্য কোটা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। উপাচার্যের দায়িত্বে নিযুক্ত সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন সভায় সভাপতিত্ব করেন। পরে রাত আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এ খবর পাওয়ার পরই শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, মীমাংসিত পোষ্য কোটা ফেরানোর বিষয়টিকে রাকসু বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। তারা যথাসময়ে উৎসবমুখর পরিবেশে রাকসু চান। সেই সঙ্গে পোষ্য কোটাও বাতিল চান।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পোষ্য কোটা ফিরে আসার খবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ শামসুজ্জোহা চত্বর থেকে একটি মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। রাত পৌনে আটটার দিকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডের পাশে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ আন্দোলনে রাকসু নির্বাচনের প্রার্থীরাও জড়ো হতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ রাকসু নির্বাচনের বিভিন্ন প্রার্থী অংশ নেন। এ সময় তাঁরা ‘পোষ্য কোটার বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন’; ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’; ‘অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন বলেন, ‘পোষ্য কোটার অসিলায় পোষ্য কোটা সামনে এনে রাকসু বানচালের চিন্তা করলে সবকিছু ভেসে যাবে। একটাই কথা, পোষ্য কোটা বাতিল করো, নইলে নকীব (উপাচার্য) গদি ছাড়ো। আপনারা মনে করেন, ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু যৌক্তিক আন্দোলনে আমরা একসঙ্গে থাকব। আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে থেকে আপনাদের অপতৎপরতা ভেঙে দেব।’
অন্যদিকে শাখা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল বলেন, ‘পোষ্য কোটা একটি মীমাংসিত বিষয়। আন্দোলনের মুখে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের সার্কুলারে পোষ্য কোটা বাদ দেওয়া হয়েছিল। সেই সার্কুলারের আলোকে ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়ে সেই সব শিক্ষার্থী এখন ক্লাস করছেন। কিন্তু রাকসু নির্বাচনের অল্প দিন আগে মীমাংসিত বিষয়কে সামনে আনা মানে হচ্ছে, রাকসু বানচালের ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে তারা এটি সামনে এনেছে। তবে তাদের এ অন্যায্য সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের আন্দোলনকে ‘ক্রেডিট নেওয়ার আন্দোলন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন পোষ্য কোটা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার। আসন্ন রাকসু নির্বাচনে তিনি ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী হয়েছেন। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের উদ্দেশে সালাউদ্দিন বলেন, এখন যে আন্দোলন হচ্ছে, এটি ক্রেডিট নেওয়ার আন্দোলন। রাকসুকে কেন্দ্র করে তারা নিজেদের প্রোফাইল ভারী করছে। প্রশাসন কিন্তু জানে, কোন পরিস্থিতিতে কোটাকে ফিরিয়ে আনলে তারা সফল হবে।
সালাউদ্দিন আম্মার আরও বলেন, ‘ছাত্রশিবির কেন সহ–উপাচার্য মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীনকে চাপ দিচ্ছে না। ছাত্রদল কেন বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের চাপ দিচ্ছে না। আমরা মাঠে আসাটা স্বাভাবিক। কারণ, বিএনপি-জামায়াত-আওয়ামী লীগ আমাদের নয়। এখানে পোষ্য কোটা নিয়ে পলিটিকস চলছে। পোষ্য কোটার আন্দোলনে ছিল ৬৫ থেকে ৭০ জনের।’
ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মূল সংগঠনের শিক্ষক-কর্মকর্তারা আন্দোলন করে পোষ্য কোটা ফিরিয়ে এনেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ও সাবেক সমন্বয়ক ফুয়াদ রাতুল। তাঁর ভাষ্য, উৎসবমুখর পরিবেশে রাকসু হবে, সেই উৎসবকে বানচাল করার জন্য পোষ্য কোটা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই পোষ্য কোটা ফিরিয়ে আনা মানবেন না শিক্ষার্থীরা।
ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি ও সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী মারুফ বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করে পোষ্য কোটা বাতিল করাতে বাধ্য করেছিলাম। কিন্তু রাকসু নির্বাচনের সামনে এই কোটা ফিরিয়ে আনা হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, পোষ্য কোটা বাতিলের আন্দোলনে আগে কখনো ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির যুক্ত ছিল না। আজ তারা ক্রেডিট নিতে এসেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরাই পোষ্য কোটা বাতিল করেছিলেন।
রাকসু নির্বাচনে হলভিত্তিক ভোট কেন্দ্রের তালিকা প্রকাশ : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে হলভিত্তিক ভোট কেন্দ্রের তালিকা প্রকাশ প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে ৯টি অ্যাকাডেমিক ভবনের ১৭টি কেন্দ্রে মোট ৯৯০টি বুথের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনের সদস্য ও ভোটকেন্দ্র স্থাপনবিষয়ক উপ-কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
যেসব ভবনে ভোট দেবেন শিক্ষার্থীরা : বিশ্ববিদ্যালয়ের মমতাজউদ্দিন অ্যাকাডেমিক ভবনে সমাজকর্ম বিভাগের ১৫৬ নম্বর কক্ষে ভোট দেবেন মন্নুজান হলের ভোটাররা, ইসমাইল হোসেন সিরাজী অ্যাকাডেমিক ভবনে ভোট দেবেন দুইটি হলের ভোটাররা। এদের মধ্যে ভবনের উত্তর গেট দিয়ে প্রবেশ করে ১২৮ নম্বর কক্ষে জুলাই-৩৬ হল এবং দক্ষিণ-পূর্ব গেট ব্যবহার করে ১২২ নম্বর কক্ষে ভোট দেবেন রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা। রবীন্দ্র ভবনে ভোট দেবেন তিনটি হলের ভোটাররা। পূর্ব-মধ্য গেট দিয়ে প্রবেশ করে ১৪৬ নম্বর কক্ষে তাপসী রাবেয়া হল, পূর্ব-দক্ষিণ ফটক দিয়ে প্রবেশ করে ১১৯ নম্বর কক্ষে বেগম খালেদা জিয়া হল এবং দক্ষিণ পশ্চিম ফটক ব্যবহার করে ১২৩ নম্বর কক্ষে রহমতুন্নেসা হলের শিক্ষার্থীরা ভোট প্রদান করবেন।
এদিকে জাবির ইবনে হাইয়ান বিজ্ঞান ভবনে ভোট দেবেন দুটি হলের ভোটাররা। ১৩৩ নম্বর কক্ষে শহিদ হবিবুর রহমান হল এবং ১০১ নম্বর কক্ষে শহিদ শামসুজ্জোহা হল। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ কলা ভবনে বাংলা বিভাগের ১৫০ নম্বর গ্যালারি কক্ষে শহিদ জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থীরা।
জামাল নজরুল ইসলাম বিজ্ঞান ভবনের সিএসএলের ১২৫ নম্বর কক্ষে বিজয়-২৪ হল এবং দক্ষিণ-পশ্চিম ফটক ব্যবহার করে ১১৬ নম্বর কক্ষে নবাব আব্দুল লতিফ হলের শিক্ষার্থীরা ভোট দেবেন।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু অ্যাকাডেমিক ভবনের ১৩৩ নম্বর কক্ষে শের-ই বাংলা ফজলুল হক হল এবং ২০৮ নম্বর কক্ষে মতিহার হল, জগদীশ চন্দ্র অ্যাকাডেমিক ভবনের টিচার্স লাউঞ্জে মাদার বখশ হল এবং ১০৫ নম্বর কক্ষে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী হলের ভোটাররা ভোট দেবেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনের পূর্ব হল রুমে সৈয়দ আমির আলী হল এবং পশ্চিম হল রুমে শাহ মখদুম হলের ভোটগ্রহণ চলবে।
ভোটগ্রহণ শেষে রাকসু কোষাধ্যক্ষ কার্যালয়ে ভোট গণনা চলবে এবং কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান বলেন, ‘রাকসু নির্বাচনে নয়টি অ্যাকাডেমিক ভবনে ১৭টি কেন্দ্র এবং ৯৯০টি বুথ স্থাপন করা হবে। এছাড়া ভোট গণনা রাকসু কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ে এবং ফলাফল ঘোষণা করা হবে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে। ভোট গণনার পুরো সময়টি সিসি টিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত থাকবে।’
এর আগে গত ২৮ জুলাই তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। সংশোধিত তফসিল অনুযায়ী ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১০টা পর্যন্ত নির্বাচনি প্রচারণা চলবে এবং ২৫ তারিখ ভোট গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
