সুসংবাদ প্রতিদিন
ফুলের রাজ্য গদখালিতে বেড়েছে ব্যস্ততা
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
তরিকুল ইসলাম তারেক, যশোর

মৌসুম সামনে রেখে ‘ফুলের রাজ্য’ খ্যাত যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর ফুল চাষিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্নে আত্মনিয়োগ করেছেন খেত প্রস্তুতে। বৈরী আবহাওয়া থেকে ফুল রক্ষায় ক্ষেতে শেড দিতে পারলে সারাবছরই বেশি বেশি ফুল আবাদ করা সম্ভব উল্লেখ করে ব্যয়বহল এ কাজে সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছেন ফুলচাষিরা। যশোর শহর থেকে বেনাপোল রোড ধরে ২৫ কিলোমিটার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী বাজার। সেখানে শের আলী নামে একজন কৃষক ১৯৮২ সালে ছোট্ট একটি নার্সারির মাধ্যমে ফুলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেন। এখন উপজেলার গদখালী, নাভারণ, শিমুলিয়া ও পানিসার ইউনিয়ন এবং ঝিকরগাছা লাগোয়া উপজেলা শার্শার ৯০টি গ্রামের প্রায় ৪ হাজার বিঘা জমিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। মাঠে গোলাপ, রজনীগন্ধা, জারবেরা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, কসমস, ডেইজি, জিপসি, রডস্টিক, স্টার, কেলেনডোলাসহ বিভিন্ন প্রকার ফুলের চাষ হয়। ফুলই এখানকার মানুষের ফসল। ভরা মৌসুমে মাঠগুলো সবুজের পরিবর্তে লাল, নীল, সাদা কিংবা হলুদ হয়ে ওঠে। যা দেখে যে কারও চোখ আটকে যায়। দেখলে মনে হবে দিগন্তজুড়ে হরেক রঙিন চাদর বিছানো বাহারি ফুলের এক স্বর্গরাজ্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশের মোট উৎপাদিত ফুলের ৭০ ভাগ উৎপাদন হয় গদখালী এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা জুড়ে। এখানকার ৭ হাজার চাষি ও অর্ধলাখ মানুষ বিভিন্নভাবে ফুল চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রায় সারা বছরই কমবেশি ফুল চাষ এবং বেচাবিক্রি হয়। তবে ডিসেম্বর থেকে মার্চ-এ ৪ মাস ফুলের ভরা মৌসুম। সাধারণত শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস, মহান বিজয় দিবস, ইংরেজি নববর্ষ, বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মহান স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষে ফুলের চাহিদা বেশি থাকে। এসব দিবসকে সামনে রেখে গদখালীর চাষিরা বেশি বেশি ফুল আবাদ করেন। এরইমধ্যে ‘ফুলের রাজ্য’ গদখালীর ময়দানে নেমে পড়েছেন ‘ফুলের রাজারা’ (ফুলচাষি)। তারা মনোনিবেশ করেছেন ক্ষেত প্রস্তুতে।
কথা হয় মাঠে কর্মরত ফুলচাষি সরদার গ্রীন ভ্যালী পার্কের সত্ত্বাধিকারি হাড়িয়া গ্রামের জালাল উদ্দীন, পানিসারা গ্রামের জাহিদ শেখ, আব্দুল আলিম, ইমামুল হাসান, জিহাদ হোসেন ও টাওয়া গ্রামের লাবণী নার্সারির মালিক লিয়াকত গাজীর সঙ্গে। গদখালী মোড় থেকে দক্ষিণ দিকে ছোট পিচের রাস্তা ধরে হাড়িয়া ফুল মোড়ে যেতে পানিসারা গ্রামের রাস্তার পূর্ব পাশে এক বিঘা জমিতে আগের বছর লাগানো গোলাাপ খেতে কাজ করছিলেন জাহিদ শেখ। তিনি বলেন, গোলাপ গাছের মরা, আধা মরা ও চিকন হয়ে যাওয়া ডালপালা থাকলে ভালো ফলন হবে না। তাই তিনি সেগুলো কেটে দিচ্ছেন। এখন সার ও পানিসহ অন্যান্য ফর্মুলা প্রয়োগ করা হবে। গাছে নতুন ডাল গজিয়ে মাস খানেকের মধ্যে গাছগুলো সজীব হয়ে উঠবে এবং ফুলে ভরে যাবে। হাড়িয়া-পানিসারা ফুল মোড়েই অবস্থিত সরদার গ্রীন ভ্যালী পার্কের মালিক জালালউদ্দীন বলেন, তার নিজস্ব জমি রয়েছে ২ বিঘা। তার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আরও ১১ বিঘা জমি লিজ নিয়ে বিভিন্ন ফুলের আবাদ করছেন। অন্তত: ২ বিঘা জমির উপরে দেওয়া শেড দেখিয়ে তিনি বলেন, এর ভেতরে সারা বছর জারবেরা ফুল চাষ করেন। বেশির ভাগ ফুল মৌসুমি, যার আবাদ তিনি এরইমধ্যে শুরু করেছেন। রাস্তার অন্য পাশে সদ্য লাগানো গাঁদা ফুল খেতে পরিচর্যার কাজ করছিলেন আব্দুল আলিম ও ইমামুল হাসান। তারা জানান, আর মাস খানেকের মধ্যে মৌসুমি ফুল উঠা শুরু হবে। টাওয়া গ্রামের মাঠে গিয়ে কথা হয় লাবণী নার্সারির মালিক লিয়াকত গাজী ও তার সহযোগী জিহাদ হোসেনের সঙ্গে। তারা বলেন, এবার প্রায় এক বিঘা জমিতে শুধু গোলাপ আবাদ করছেন উল্লেখ করে তিনি জানান, এতে লাখ দুয়েক টাকা খরচা হবে। আবহাওয়াসহ সবকিছু অনুকূলে থাকলে খরচ বাদে তার আরও দু’লাখ টাকা মুনাফা হতে পারে। আলাপকালে এসব ফুলচাষি সরকারি সহায়তার বিষয়ে হতাশার সুরে কথা বলেন। তারা জানান, বৈরী আবহাওয়া থেকে রক্ষার জন্য জমিতে শেড দিতে পারলে সারা বছরই অনেক ফুলের আবাদ করা যায়। কিন্তু এতে অনেক খরচ। এক বিঘা জমিতে শেড দিতে গেলে এক কোটি টাকার মতো খরচ উল্লেখ করে তারা জানান, এখানকার ফুলচাষিদের এতো মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করার সামর্থ্য নেই। সরকারের বিভিন্ন মহলে বারবার বলেও তারা সাড়া পাননি। সরকারি সহায়তা পেলে ফুলচাষে আরও অগ্রগতি হবে।
যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সহসভাপতি মঞ্জুর আলম বলেন, ‘গত বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, অনাবৃষ্টি এবং শীতে দু’দফায় ভারী ও টানা বৃষ্টিতে চাষিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ফুলচাষিরা লোকসান কাটিয়ে এবছর লাভের মুখ দেখতে পাবেন।’ তিনিও ফুলচাষের উন্নয়নে সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছেন। কৃষকদের থেকে উত্থাপিত শেডের ব্যাপারে ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার আব্দুস সামাদ জানান, ফুল চাষের জন্য সরকারিভাবে কোনো প্রকল্প নেই। তবে, কৃষকদের এ দাবি তারা ঊর্ধ্বতনদের বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে জানিয়েছেন। তারাও এ বিষয়ে অবগত আছেন। ঊর্ধ্বতনরা বরাবরই আমাদের আশ্বস্ত করেন। আমরাও কৃষকদের আশার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, ‘ফুল চাষ তো সারা দেশে নয়, নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে বেশি হচ্ছে বিধায় সরকারিভাবে এখনও কোনো প্রকল্প গৃহীত হয়নি। সরকার এ ব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগ নিলে মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
