সুসংবাদ প্রতিদিন

ডাবে বদলে যাচ্ছে ভোলার অর্থনীতি

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফরহাদ হোসেন, ভোলা

ধান, সুপারি, ইলিশের গোলা এই তিনে দ্বীপ জেলা ভোলা। এ প্রবাদ যা মূলত ভোলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এই অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল হলো- ধান, সুপারি এবং প্রধান সম্পদ হলো ইলিশ মাছ, যা ভোলা জেলার অর্থনৈতিকভিত্তি এবং মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু সময় বদলেছে। একসময় যেখানে সাগরের নোনা জলের ভয়ে কৃষকরা আবাদ করতে সংকোচ বোধ করতেন, এখন সে জমিতে সারি সারি ডাবগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ভোলা এখন ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে দেশের নতুন ‘ডাবের জেলা’ হিসেবে। মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার বেষ্টিত সবুজ-শ্যামল এক অঞ্চলে নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে ডাব চাষে। এখন অনেকের মুখে এক কথাই শোনা যায়, ডাবেই ভোলার ভাগ্য বদলাচ্ছে।

ভোলার অনুকূল আবহাওয়া, লবণাক্ততা সহনশীল মাটি এবং নদীঘেরা প্রকৃতি নারকেল গাছ বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠোনে দেখা যায়, এক বা একাধিক নারকেল গাছ। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাষাবাদ আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, এখন এটি রূপ নিয়েছে বাণিজ্যিক উৎপাদনে। জেলার মনপুরা, বোহানউদ্দিন, লালমোহন, তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন ও দৌলতখান উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে হাজার হাজার একর জমিতে ডাব চাষ হচ্ছে। ডাব চাষিরা জানিয়েছেন, ধান বা অন্য ফসলের তুলনায় ডাব চাষে খরচ কম, পরিশ্রম কম, কিন্তু আয় অনেক বেশি।

লালমোহনের ডাব চাষি লোকমান বলেন, ‘আগে ধান চাষ করতাম, লাভ হতো না। এখন এক একর জমিতে প্রায় ৮০-১০০টি নারকেল গাছ আছে। বছরে কয়েকবার ডাব বিক্রি করা যায়, ফলে সারাবছর আয় থাকে। একসময় মৌসুমী আয়ের ওপর নির্ভরশীল কৃষকরা এখন সারা বছর ডাব বিক্রি করে উপার্জন করছেন। এতে শুধু কৃষকের জীবনযাত্রার মানই উন্নত হয়নি, বেড়েছে গ্রামীণ অর্থচক্রের গতি।

ভোলার ডাব এখন শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, বরং দেশের বড় শহরগুলোতেও ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে। প্রতিদিন ভোলা থেকে শত শত ট্রাক ও লঞ্চযোগে ডাব ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটের বাজারে যাচ্ছে। ডাব পরিবহনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে গাছি, পরিবহন শ্রমিক, মাঝি, পাইকার ও ব্যবসায়ীসহ হাজারও মানুষ। ডাব ব্যবসায়ীরা বাড়িতে এসে বাগান থেকে তাদের লোক দিয়ে গাছ থেকে পেরে প্রতিটি ডাব ৫০ থেকে ৫৫ টাকা করে কিনে নিয়ে যায়। এখন অনেক তরুণ উদ্যোক্তা অনলাইনেও ডাব বিক্রি শুরু করেছেন। ফেসবুক পেজ, অনলাইন মার্কেটপ্লেস কিংবা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সরাসরি অর্ডার নিচ্ছেন তারা।

ডাবের পানি এখন আন্তর্জাতিক বাজারে ‘হেলদি ড্রিংক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এরইমধ্যে ভোলার কিছু উদ্যোক্তা ডাব ও নারকেল ভিত্তিক পণ্য বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার-বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে ভোলাকে একটি ডাব প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, যা দেশীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। ডাব চাষ পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই কৃষির উদাহরণ হতে পারে। এটি একদিকে কৃষকদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করছে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলাতেও ভূমিকা রাখছে।

লালমোহনে ডাব ও নারিকেল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বাজারে ডাবের অনেক চাহিদা রয়েছে। আমাদের এই জেলায় ২০০টির অধিক আড়ৎ এর আওতায় অন্তত ২৫০০ থেকে ৩০০০ হকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাব কিনে আনেন। তাদের থেকে আবার আমরা ওইসব ডাব কিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠাই। বছরের ৬ মাস বাজারে ডাবের চাহিদা বেশি থাকে। তবে গড়ে আমরা এই জেলা থেকে প্রতি মাসে দেশের বিভিন্নস্থানে অন্তত ১০ থেকে ১১ কোটি টাকার ডাব পাঠাতে পারি। এতে করে ভোলা অর্থনীতি কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে। ভোলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ভোলায় প্রায় ১৮৫০ হেক্টর জমিতে ১৮ লাখ ২৭ হাজার গাছ রয়েছে। বছরে প্রায় ১৫০০০ হাজার মেট্রিকটন ডাব উৎপাদন করা হয়। যা বিক্রি হয় প্রায় ১১ কোটি টাকা।

তারা আরও জানান, সরকার খামার বাড়ি প্রকল্প হতে বশত বাড়িতে উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায় এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগবালাই রোধে ফার্টিলাইজারসহ প্রতি বছর গড়ে ৩০ হাজার নারিকেল চারা বিনামূল্যে বিতরণ করেন। ডাব উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপজেলা পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা ও গ্রাম ভিত্তিক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দেখভাল করছেন। ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. খাইরুল ইসলাম মল্লিক বলেন, ডাব চাষ করলে কম শ্রম ও স্বল্প খরচে ভালো লাভবান হওয়া যায়। এছাড়া ১২ মাসই ডাব বিক্রি করতে পারেন কৃষকরা। যার জন্য এরইমধ্যে উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ডাব চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কয়েকটি প্রদর্শণী দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ডাব চাষ বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য কেউ আগ্রহী হলে আমরা তাকে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

ডাবভিত্তিক এই কৃষি বিপ্লব ভোলার গ্রামীণ অর্থনীতিকে দিয়েছে নতুন প্রাণ, নতুন পরিচয় এবং অসংখ্য মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে আশার আলো বলছেন দ্বীপজেলাবাসী। আগে যেখানে অনেক কৃষক আবাদি জমিতে কম লাভজনক ফসল উৎপাদন করে টিকে থাকতে হিমশিম খেতেন, এখন সেই জমিতেই ডাবের বাগান গড়ে আয় বাড়াচ্ছেন কয়েকগুণ। ডাব চাষের জন্য প্রয়োজন কম সার, কম শ্রম এবং তুলনা মূলকভাবে কম ঝুঁকি, ফলে নতুন কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন এ খাতে। স্থানীয়দের ভাষায়, ডাব এখন শুধু ফল নয়; এটি ভোলার মানুষের স্বপ্ন। তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন, মনপুরাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ডাবের বাগান এখন এক নতুন দৃশ্যপট তৈরি করেছে যেখানে সবুজ সারির পর সারি ডাবগাছ দাঁড়িয়ে আছে সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে। ফলে ভোলার পরিচয় বদলে যাচ্ছে- এখন এটি নদী, মাছ, ধান আর সুপাড়ির পাশাপাশি পরিচিত হচ্ছে ডাবের জেলা নামেও। কৃষিভিত্তিক এই নবযাত্রা দ্বীপজেলার মানুষের মনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে, যা ভোলাকে দেশের অন্যতম প্রধান ডাব উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।