প্রথম দিন সেন্টমার্টিনে ১১৭৪ পর্যটক

* এক জাহাজকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা * সেন্টমার্টিন থেকে আসার পথে স্পিডবোট উল্টে মা-মেয়ের মৃত্যু

প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  কক্সবাজার অফিস

জাহাজ চলাচলের প্রথম দিন প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমণে গেছেন ১১৭৪ জন পর্যটক। গতকাল সোমবার সকাল ৭টা থেকে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়াস্থ বিআইডব্লিউটিএ-এর ঘাট থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা দেয় একে একে ৩টি জাহাজ। যে সব জাহাজ দুপুর ১টার পর থেকে পৌঁছে গেছে সেন্টমার্টিন জেটি ঘাটে।

সেন্টমার্টিন রুটের পর্যটকবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন ‘সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ১ ডিসেম্বর প্রথম দিন কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, এমবি বার আউলিয়া ও কেয়ারি সিন্দাবাদ এই ৩টি জাহাজ সকাল ৭টায় যাত্রা শুরু করে। যেখানে ১১৭৪ জন পর্যটক রয়েছে। বেলা ৩টার দিকে জাহাজ ৩টি সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা দেবে। তবে কোনো পর্যটক এ জাহাজ যোগে আজ ফিরছেন না। তারা যেখানে রাত্রি যাপন করবেন। আজ মঙ্গলবার সকালে আবারও পর্যটক নিয়ে জাহাজ সেন্টমার্টিন যাবে।

তিনি বলেন, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুই মাস কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়াস্থ বিআইডব্লিউটিএ-এর ঘাট থেকে সেন্টমার্টিনে পর্যটক নিয়ে জাহাজ চলাচল করবে। ঘাটে আরও ৪ জাহাজ প্রস্তুত থাকা রয়েছে। অনুমতি নিয়ে পর্যায়ক্রমে এই ৪টি জাহাজও সেন্টমার্টিন যাত্রা শুরু করবে।

মূলত নানা আলোচনা, নীতি, সিদ্ধান্ত পেরিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাত্রা করেছে এই ৩টি জাহাজ। আর জাহাজ উঠা থেকে শুরু সবখানে নির্দেশনা মানাতে কঠোর অবস্থানে দেখা গেছে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের। গতকার সোমবার সকালে জাহাজ যাত্রা দেওয়ার আগে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়াস্থ বিআইডব্লিউটিএ-এর ঘাটে দেখা গেছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের। যেখানে ১২ নির্দেশনার নিয়ে মাইকিং করা হয়েছে। প্রতিটি স্তরে রয়েছে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি, প্লাস্টিক কিংবা পলিথিন দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে ব্যবস্থা এবং সচেতন করা হয়।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান জানান, প্রথম দিন ৩টি জাহাজ কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন গেছে। নিয়ম মতে ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করে পর্যটকদের টিকেটসহ সব করা হচ্ছে। ২ হাজারের বেশি যেন যেতে না পারে তার জন্য কঠোর নজরধারি রয়েছে। তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের জারি করা ১২টি নির্দেশনা কঠোরভাবে বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন সর্বোচ্চ সজাগ। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং অন্যান্য দপ্তর মিলে তা বাস্তবায়নে মাঠে রয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন জানান, সেন্টমার্টিনে পর্যটক আসা-যাওয়ার সময় জাহাজগুলোকে কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। দুই হাজারের বেশি পর্যটক যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এ জন্য নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট ও সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে পৃথক তল্লাশির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় পুলিশ সর্বোচ্চ সর্তক রয়েছে। উভয় ঘাট ছাড়াও প্রতিটি জাহাজে ট্যুরিস্ট পুলিশ অবস্থান করছে। এদিকে প্রথম দিন নিয়মের বাইরে গিয়ে টিকিট বিক্রি করায় সেন্টমার্টিনগামী পর্যটকবাহী জাহাজ কেয়ারি সিন্দাবাদ কর্তৃপক্ষকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে প্রশাসন। কক্সবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াছমিন জানান, ট্রাভেল পাস ছাড়া টিকেট বিক্রির নিয়ম নেই। এই নিয়ম না মেনে ৩টি টিকেট বিক্রি করায় জারিমানা করা হয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ব্যাপারে গত ২২ অক্টোবর ১২টি নির্দেশনাসহ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন।

সরকারি সিদ্ধান্ত মতে বঙ্গোপসাগরের বুকে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন পর্যটকেরা। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। তবে পর্যটকদের মানতে হবে সরকারের ১২টি নির্দেশনা। সরকারি প্রজ্ঞাপন মতে, নভেম্বরে পর্যটকেরা শুধু দিনের বেলায় দ্বীপটি ভ্রমণ করতে পারবেন। রাত যাপন করতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি দুই মাস রাত যাপনের সুযোগ থাকবে।

এ ছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ১২টি নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ এবং মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সেন্টমার্টিন দ্বীপে কোনো নৌযান চলাচলের অনুমতি পাবে না। পর্যটকদের অবশ্যই বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। সেখানে প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস এবং কিউআর কোড সংযুক্ত থাকবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।

তথ্য অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সেন্টমার্টিন দ্বীপে যেতে পারবেন পর্যটকেরা। আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার ৯ মাসের জন্য দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। দ্বীপে ভ্রমণের সময়সূচি এবং পর্যটক উপস্থিতিও এবার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করতে পারবেন না।

পর্যটকদের ভ্রমণকালে রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বারবিকিউ পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়-বিক্রয়, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষেধ। সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ যেকোনো মোটরচালিত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

ভ্রমণকালে নিষিদ্ধ পলিথিন বহন করা যাবে না এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক, যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, ৫০০ ও ১০০০ মিলিলিটারের প্লাস্টিক বোতল ইত্যাদি বহন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপে যাওয়ার পথে স্পিডবোট উল্টে মা-মেয়ের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে নৌপথটির ‘গরারচর’ মোহনায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মাঝরপাড়ার বাসিন্দা নাজির আহমেদের মেয়ে মরিয়ম আক্তার (৩৫) ও তাঁর শিশু মেয়ে মাহিমা খাতুন (৬)। আহত ব্যক্তিদের নামণ্ডপরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্পিডবোটটিতে চালকসহ আটজন ছিলেন। ডুবোচরে উল্টে পড়ার পর তাঁদের সবাইকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে চারজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়জুল ইসলাম বলেন, শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণে বদরমোকাম ঘোলারচড় এলাকায় ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। ভাটার সময় এই চরের কিছু অংশ দেখা গেলেও জোয়ারের সময় এটি অদৃশ্য থাকে। এই ডুবোচরেই দ্রুতগতির স্পিডবোটটি উল্টে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আসিফ আলভি বলেন, ‘হাসপাতালে আনার আগেই মা-মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। অন্য দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটারের এই নৌপথে যাত্রী পরিবহন করছে ৫০টির বেশি স্পিডবোট। অধিকাংশ স্পিডবোটের চলাচলের বৈধ লাইসেন্স নেই। কিছু স্পিডবোট চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ছোট আকৃতির এসব স্পিডবোট এরপরও ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে।

নাম প্রকাশ না শর্তে একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘাটে ঘাটে ম্যানেজ করে স্পিডবোটগুলো চলাচল করছে। অধিকাংশ স্পিডবোটে লাইফ জ্যাকেটই রাখা হয় না। চারজন ধারণক্ষমতার স্পিডবোটে ওঠানো হয় ৭ থেকে ১০ জন।’

সম্প্রতি বিআইডব্লিউটিএ স্পিডবোটগুলোকে লাইসেন্সের আওতার নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে। অনলাইনে ফরম পূরণ করে স্পিডবোটের বিপরীতে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।