ভারতকে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি দেবে রাশিয়া, ঘোষণা পুতিনের

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

দু’দিনের ভারত সফরে এসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছেন, তার দেশ ভারতকে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে প্রস্তুত। ভারতকে তাদের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে মস্কো দিল্লিকে সহায়তা করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে উঠে এসেছে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গও। তবে পুতিন-মোদি বৈঠকে যুদ্ধবিমান সরবরাহসহ কয়েকটি সামরিক চুক্তি হবে বলে মনে করা হলেও বিবিসির সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, সেরকম বড় কোনো চুক্তিই দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব ঘোষণা করেননি। গত শুক্রবার দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ২৩তম ভারত-রাশিয়া বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী ও ভ্লাদিমির পুতিন। ওই বৈঠকের শেষে দুই নেতার সামনেই সংবাদ সম্মেলনে একাধিক সমঝোতাপত্র বিনিময় করেন ভারত ও রাশিয়ার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা। সব সমঝোতাই বাণিজ্য বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয়েছে বলে বিবিসির সংবাদদাতারা জানিয়েছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে জাহাজ নির্মাণ, মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে কাজ করার জন্য ভারতীয় নাবিকদের প্রশিক্ষণ, নতুন জাহাজ পথ গড়ে তুলতে বিনিয়োগ, বেসামরিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ খাত প্রভৃতি। দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষ করে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী ও ভ্লাদিমির পুতিন। তবে তারা সাংবাদিকদের কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন নেননি। সংবাদ সম্মেলনে প্রথমে ভাষণ দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি জানান, পুতিনের সঙ্গে তার বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বিভিন্ন দিক নিয়েই আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্ব পেয়েছ অর্থনৈতিক সহযোগিতা।

ভারত ও রাশিয়া ২০৩০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি রূপরেখা চূড়ান্ত করেছে। রাশিয়ায় ভারতের দুটি নতুন দূতাবাস খোলার সিদ্ধান্ত এবং দুটি নতুন পর্যটক ভিসা প্রকল্পও চূড়ান্ত হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বলতে গিয়ে মোদি বলেন, ভারত প্রথম থেকেই শান্তির পক্ষে থেকেছে, এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খোঁজার যে প্রচেষ্টা চলছে, তাতে অংশ নিয়েছে।

মোদির কথায়, ইউক্রেন সংকটের পর থেকে আমাদের মধ্যে সব সময় কথা হয়। আপনিও (পুতিনকে উদ্দেশ্য করে) প্রকৃত বন্ধুর মতো প্রতিটা বিষয় আমাকে জানিয়েছেন। এই পারস্পরিক বিশ্বাসই আমাদের সম্পর্কের বড় শক্তি।

আমাদের সবার মিলিতভাবে শান্তির পথ খোঁজা উচিত। সম্প্রতি সেই প্রচেষ্টা চলছে। আমার ভরসা আছে যে বিশ্ব আবারও শান্তির পথে ফিরে আসবে। আমি বারবার বলেছি যে ভারত নিরপেক্ষ নয়। ভারতেরও পক্ষপাতিত্ব আছে এবং সেটা শান্তির পক্ষে। আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠার সব প্রচেষ্টাকে সমর্থন করব” বলেছেন নরেন্দ্র মোদি।

এরপরে তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত এবং রাশিয়া দীর্ঘ সময় ধরে একে অপরকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে।

ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে ‘যাতায়াত’ বৃদ্ধি করা তাদের কাছে ‘অতি গুরুত্ব’ পেয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন মোদি।

পারমাণবিক বিদ্যুতের প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে “জ্বালানি নিরাপত্তা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।”

নরেন্দ্র মোদির ভাষণের পর সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি প্রথমেই বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তার বেশ কয়েকবার টেলিফোনে আলোচনা হয়েছে।

পুতিন বলেন, “টেলিফোনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়। রাশিয়া আর ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যথেষ্ট মজবুত। আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক অর্থনৈতিক বিষয়সহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে আরও মজবুত হচ্ছে।”

“আমাদের মধ্যে বাণিজ্য এখন রুবল আর ভারতীয় টাকায় চলছে। আমরা মেক ইন ইন্ডিয়া পরিকল্পনাকে সহযোগিতা করব। লজিস্টিক রুট গড়ে তোলার জন্য দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। আমরা ভারত মহাসাগরের রুট নিয়ে কথা চালাচ্ছি।”

বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং জ্বালানি প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে পুতিন বলেন, “রাশিয়া ভারতকে জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করতে প্রস্তুত।”

ভারত যাতে রাশিয়া থেকে তেল না কেনে তার জন্য দিল্লির ওপরে যুক্তরাষ্ট্র যখন চাপ দিচ্ছে, তার মধ্যেই ভ্লাদিমির পুতিন এ ঘোষণা করলেন।

এছাড়াও ভারত যে বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে, তাতেও রাশিয়া সহযোগিতা করছে বলে জানান পুতিন। তামিলনাডুর কুদানকুলামে ভারতের এই বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, “ছয়টির মধ্যে দুটি ইউনিট ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে, বাকি চারটি নির্মীয়মান অবস্থায় আছে। পুরোপুরি কাজ শুরু করলে এটি ভারতের স্বচ্ছ ও সাধ্যের মধ্যে মূল্যে বিদ্যুতের যে চাহিদা আছে, তাতে বড় অবদান রাখবে।”

“আমরা ছোট মডিউলার রিঅ্যাক্টর, ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ওষুধ ও কৃষি শিল্পের জন্য পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করছি”, জানিয়েছেন পুতিন।

ভারতের সঙ্গে যে আলাপ আলোচনা হয়েছে এবং যে-সব সমঝোতা সই হয়েছে, তাতে রাশিয়া থেকে তার সঙ্গে আসা প্রতিনিধিদল সন্তুষ্ট বলে মন্তব্য করে নিজের ভাষণ শেষ করেন পুতিন।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিল্লির পালাম বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাকে যে বিমানবন্দরে – একেবারে বিমানের দোরগোড়ায় স্বাগত জানাতে হাজির থাকবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, এটা আগে থেকে ঠিক করা ছিল না বলে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে। তারা একই গাড়িতে বিমানবন্দর ছেড়ে বের হন।

শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয় নানা কার্যক্রম। প্রথমেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। সেখানে তাকে ‘গার্ড অফ অনার’ দেয় ভারতের সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্যরা।

এর পরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সমাধিস্থল রাজঘাটে গিয়ে তার স্মৃতি সৌধে মালা দেন পুতিন। তারপরেই ছিল এই সফরের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ- মোদি ও পুতিনের বৈঠক। দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে এই বৈঠক শুরু হয় বেলা ১২টার দিকে। এরপরে সেখানেই সাংবাদিকদের সামনে প্রথমে সমঝোতাপত্র বিনিময় করা হয় এবং পরে সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দেন দুই শীর্ষ নেতা।

বিকেলে ভারত-রাশিয়া বিজনেস ফোরামের বৈঠকে যোগ দেন দুই শীর্ষ নেতা। এর পরে রাশিয়ার সরকারি টিভি চ্যানেল রাশিয়া টুডে’র দিল্লি সংবাদ ব্যুরো উদ্বোধন করবেন মি. পুতিন। সেখান থেকে তার আবারও রাষ্ট্রপতি ভবনে যান। ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মূ মি. পুতিনের সম্মানের এক রাষ্ট্রীয় ভোজের আয়োজন করেছিলেন। ভারতীয় সময় রাত নয়টায় দিল্লি থেকে রাশিয়া ফিরে গেছেন ভ্লাদিমির পুতিন।

রুশ নাগরিকদের জন্য ৩০ দিনের ফ্রি পর্যটক ভিসা চালু করছে ভারত : শিগগিরিই রুশ নাগরিকদের জন্য ৩০ দিনের ফ্রি পর্যটক ভিসা চালু করছে ভারত। গত শুক্রবার নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে বৈঠকের পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গতকাল শনিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। সংবাদ সম্মেলনে ভারত ও রাশিয়ার সাংস্কৃতিক সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে সংযোগ সবসময়ই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে বিবেচনায় রাশিয়ার নাগরিকদের জন্য ভারত ৩০ দিনের ফ্রি ই-পর্যটক ভিসা এবং ৩০ দিনের গ্রুপ পর্যটক ভিসা চালু করবে।’ তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি রাশিয়ায় দুটি নতুন ভারতীয় কনস্যুলেট খোলা হয়েছে। এটি দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে যোগাযোগ আরও সহজ করবে, পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই কনস্যুলেটগুলো আমাদের কূটনৈতিক উপস্থিতি বাড়াবে। একই সঙ্গে বাণিজ্য, পর্যটন, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরও বাড়ানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করবে।

ভারতের এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ উদ্যোগ কেবল দুই দেশের জনগণকে সংযুক্ত করবে না, বরং উভয় দেশের জন্য নতুন শক্তি ও নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। আমরা যৌথভাবে কারিগরি শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণেও কাজ করব। দুই দেশের ছাত্র, গবেষক ও ক্রীড়াবিদদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ও বাড়ানো হবে।

সংবাদ সম্মেলনে মোদি বলেন, ‘আমার পূর্ণ বিশ্বাস আগামী সময়ে, আমাদের বন্ধুত্ব বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার শক্তি দেবে, এই পারস্পরিক আস্থা ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ করবে।’

এ সময় গত অক্টোবরে ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধের অবশিষ্টাংশের প্রদর্শনী রাশিয়ার কালমাইকিয়াতে অসাধারণ সাড়া ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, হাজার হাজার ভক্ত মঠে অবশিষ্টাংশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।