সুসংবাদ প্রতিদিন

গোলের গুড়ের নোনতা মিষ্টি স্বাদেই বদলে যাচ্ছে উপকূলের দিন

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এম কে রানা, পটুয়াখালী

পটুয়াখালীর উপকূলে দিন দিন বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনচিত্র। নোনতা মিষ্টি স্বাদের এক প্রাকৃতিক গুড় ‘গোলের গুড়’ এখন শুধু খাদ্যপণ্য নয়, হয়ে উঠেছে উপকূলীয় মানুষের টিকে থাকার শক্ত ভিত্তি। জোয়ার ভাটার সঙ্গে লড়াই করা এই অঞ্চলে যেখানে চাষাবাদ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, সেখানে স্থানীয়ভাবে জন্মানো গোলগাছের রস বহু পরিবারকে এনে দিয়েছে বিকল্প ও স্থায়ী আয়ের পথ।

পটুয়াখালীর উপকূলজুড়ে বিস্তৃত প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই জন্মায় গোল গাছ। লবণাক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই গাছের রস থেকে তৈরি হয় বিশেষ স্বাদের গুড়, যার নোনতা মিষ্টি স্বাদ ও অনন্য সুবাস আলাদা করে চেনার মতো। দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় বাজারে গোলের গুড়ের কদর থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই পণ্য এখন উপকূলের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে।

কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নেয়ামতপুর গ্রামের বাসিন্দা বাবুল চন্দ্র মিস্ত্রী বহু বছর ধরে গোলের রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি গোলগাছে মাটির কলস ঝুলিয়ে দেন। রাতভর ফোঁটা ফোঁটা করে জমে ওঠে রস। ভোরের আলো ফোটার আগেই সেই রস সংগ্রহ করে চাতালে তোলা হয়। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাল দিয়ে রস জাল দিয়ে তৈরি করা হয় গুড়। বাবুল চন্দ্র মিস্ত্রীর মতো শত শত মানুষ বছরের এই তিন মাসের মৌসুমকে ঘিরেই সংসারের বড় একটি ভরসা খুঁজে পান।

স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে গোলের গুড় এখন পাইকারদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও পৌঁছে যাচ্ছে। শীত মৌসুম এলেই উপকূলজুড়ে বাড়ে কর্মচাঞ্চল্য। বর্তমানে পটুয়াখালী জেলায় প্রায় ১০০ হেক্টর এলাকাজুড়ে ৫ শতাধিক পরিবার গোলগাছের রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। বাজারে কেজিপ্রতি ২৬০-২৮০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া এই গুড় কৃষকদের জন্য তৈরি করছে প্রতিদিনের নগদ আয়ের সুযোগ। গড়ে একজন কৃষক প্রতিদিন ৭-৮ কেজি গুড় উৎপাদন করে আয় করছেন প্রায় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা।

চাষিরা বলছেন, গোলের গুড়ের এই আয় তাদের পারিবারিক স¦চ্ছলতা ফিরিয়ে আনছে। সন্তানদের পড়াশোনা, চিকিৎসা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহে এখন তারা অনেকটাই স্বাবলম্বী। তবে উৎপাদন প্রক্রিয়া এখনও অনেকাংশেই সনাতন পদ্ধতি নির্ভর। আধুনিক চুল্লি, সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পেলে উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তারা। পাশাপাশি বাজারজাতকরণে সরকারি সহায়তা পেলে লাভের পরিমাণ আরও বাড়বে বলেও প্রত্যাশা চাষিদের।

উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, গোল চাষ ও গুড় উৎপাদনকে একটি টেকসই বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আরাফাত হোসেন বলেন, উপকূলীয় এলাকায় গোল গাছ পরিবেশের সঙ্গে সহজেই খাপ খাইয়ে নেয়। পরিকল্পিতভাবে বাগান তৈরি, রস সংগ্রহের আধুনিক পদ্ধতি এবং মানসম্মত গুড় উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে এই খাত আরও সম্প্রসারিত হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও গোল বাগান সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ আমানুল ইসলাম জানান, গোলের গুড়ের মান উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসম্মত প্রক্রিয়াজাতকরণ ও আধুনিক প্যাকেজিং নিশ্চিত করা গেলে দেশের বাজারের পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী, মাত্র তিন মাসের রস মৌসুমেই একজন কৃষকের আয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় দুই লাখ টাকা। সব মিলিয়ে কলাপাড়া অঞ্চলের কৃষকরা দৈনন্দিন কাজের বাইরে এসে বছরে মাত্র তিন মাসেই গোলের রস ও গুড় উৎপাদনের মাধ্যমে আয় করছেন ১০ কোটি টাকারও বেশি। নোনতা মিষ্টি স্বাদের এই গুড় তাই আজ আর শুধু একটি খাদ্যপণ্য নয় এটি উপকূলের নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় টেকসই পরিবর্তনের এক শক্ত প্রতীক।