আন্দোলন দমনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতেন সালমান ও আনিসুল
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
চব্বিশের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতেন সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হক। ট্রাইব্যুনালে এ তথ্য জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি উল্লেখ করেন, তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্দেশে ২৮৬টি মিথ্যা মামলায় সাড়ে চার লাখ ছাত্র-জনতাকে আসামি করা হয়েছিল। গতকাল সোমবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এ শুনানি হয়। অপর সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারফিউ দিয়ে গণহত্যায় উসকানির দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার অভিযোগ গঠনের বিষয়ে এদিন শুনানি হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে আসামি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। এসবের ওপর শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর। প্রথমেই সালমান ও আনিসুলের ব্যক্তিগত দায় পড়ে শোনান তাজুল ইসলাম। একপর্যায়ে তাদের একটি ফোনালাপ বাজিয়ে শোনানো হয়। ফোনালাপটি ২০২৪ সালের ১৯ জুলাইয়ের। এরপরই সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ আলাদা আলাদা পড়েন তিনি।
প্রথমত, চব্বিশের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতেন সালমান ও আনিসুল। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯ জুলাই ফোনে কথা বলেন তারা। তাদের কথোপকথনের একপর্যায়ে শোনা যায়- ওদের শেষ করে দেওয়া। অর্থাৎ ‘আজ রাতেই কারফিউ জারির মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের শেষ করে দিতে হবে’ বলে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
এরই ধারাবাহিকতায় ২২ জুলাই ব্যবসায়ীদের নিয়ে গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন সালমান এফ রহমান। ওই বৈঠকে জীবন দিয়ে হলেও হাসিনার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যেই আইনমন্ত্রীর নির্দেশে ২৮৬টি মিথ্যা মামলা করা হয়। যেখানে সাড়ে চার লাখ ছাত্র-জনতাকে আসামি করা হয়েছিল। তাদের এমন ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনায় প্রাণ দিয়েছেন বহু ছাত্র-জনতা। তবু নির্যাতন বন্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি তারা। দ্বিতীয়ত, সালমান-আনিসুলের জ্ঞাত অনুসারে ২৩ জুলাই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। অর্থাৎ তাদের প্ররোচনা-উসকানিতে মিরপুরে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় বাহিনী। তৃতীয়ত, মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্র করেছিলেন এই দুই প্রভাবশালী। তাদের উসকানি ও সহায়তায় ২৮ জুলাই মিরপুর-১০ এ আক্তারুজ্জামানকে জীবন দিতে হয়। আহত হন আরও অনেকে। চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, কারফিউ জারির মাধ্যমে মারণাস্ত্র ব্যবহারে উসকানি-প্ররোচনায় ৪ আগস্ট মিরপুর-১ এ আকাশ, সেতু, আলভীসহ ১২ জনকে হত্যা করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পাঁচ নম্বরে বলা হয়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে পরিকল্পনা করেন সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হক। তাদের নির্দেশে প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের হামলায় মিরপুর-২, ১০ ও ১৩ নম্বরে আল-আমিন, আশরাফুল, সাব্বির, রিতাসহ ১৬ জন হত্যার শিকার হন।
ব্যাপকমাত্রা ও পদ্ধতিগত অপরাধ করেছেন সালমান ও আনিসুল। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগই গঠনের জন্য আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। পরে আসামিপক্ষে শুনানির জন্য সময় চান সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী। তার আবেদন মঞ্জুর করে সালমান-আনিসুলের পক্ষে শুনানির জন্য আগামী ৪ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
সাজা থেকে খালাস চাইলেন সাবেক আইজিপি মামুন : জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পাঁচ বছরের সাজা থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেছেন মামলার রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আপিল আবেদন করা হয়েছে বলে গতকাল সোমবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন আইনজীবী মধুমালতী চৌধুরী বড়ুয়া। এ মামলায় আসামি থেকে রাজসাক্ষী বনে যাওয়া কারাগারে থাকা সাবেক আইজিপিকে গত ১৭ নভেম্বর ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেল। প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ওইদিন বহুল আলোচিত এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একপর্যায়ে দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রোভার) হন সাবেক আইজিপি মামুন।
এ মামলার যে অভিযোগে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে, তাতে তাদের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড চেয়ে গত ১৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে আবেদন করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। এবার সাজা থেকে খালাস চেয়ে আপিল করলেন সাবেক আইজিপি মামুন।
চানখারপুলে ছয় হত্যা : আসামিপক্ষে ফের যুক্তিতর্ক বুধবার
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজধানীর চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আংশিক যুক্তিতর্ক শেষ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) দিন নির্ধারণ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। অন্য সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ।
এ মামলার গ্রেপ্তার চার আসামি হলেন- শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ?ও মো. নাসিরুল ইসলাম। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাদের আজ সকালে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ।
পলাতকরা হলেন- সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল। চলতি বছরের ১৪ জুলাই আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
এদিন প্রথমেই যুক্তি উপস্থাপন করেন শাহবাগ থানার তৎকালীন পরিদর্শক (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেনের আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি। এ মামলায় দেওয়া ৯ জন সাক্ষীই নিজেদের জবানবন্দিতে আরশাদের নাম উল্লেখ করেনি বলে জানিয়েছেন তিনি।
ট্রাইব্যুনালকে অভি বলেন, পুলিশে পরিদর্শক পদে ছিলেন আরশাদ হোসেন। পদ অনুযায়ী কমান্ডিং অফিসার হতে পারেন না তিনি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশেই জুলাই আন্দোলনে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেওয়া পুলিশ সদস্যরাও তার নাম বলেননি। তারা বলেছিলেন এডিসি আখতারের নির্দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এরপর কনস্টেবল সুজন ও নাসিরুলের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন আইনজীবী সিফাত মাহমুদ শুভ ও আবুল হাসান। এ মামলায় নিজেদের ক্লায়েন্টের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ আনতে পারেনি বলে জানিয়েছেন তারা। পরে পলাতক চার আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কুতুবউদ্দিন আহমেদের পক্ষে সময় চাওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাকি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আগামী বুধবার নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে, ১৫ ডিসেম্বর প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। তিনি এ মামলার আদ্যোপান্তসহ গত বছরের ৫ আগস্ট চানখারপুলের ঘটনায় আসামিদের কে কোন অপরাধ করেছেন, কার কতটুকু সংশ্লিষ্টতা ছিল; সব তুলে ধরেন। ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের সরাসরি নির্দেশে ছয়জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। সবশেষ আট আসামির সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রার্থনা করেন এই প্রসিকিউটর।
১০ ডিসেম্বর এ মামলার আসামি আরশাদ হোসেনের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন জুয়েল মাহমুদ। ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে নিজের পক্ষে নিজেই সাফাই সাক্ষ্য দেন আরশাদ হোসেন। একই দিন জবানবন্দি দিয়েছেন মো. সোলাইমান। ৩০ নভেম্বর আরশাদ হোসেনের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য নেওয়ার আবেদনের ওপর শুনানি করেন আইনজীবী অভি। পরে তার আবেদন মঞ্জুর করে তিনজন সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার অনুমতি দেন ট্রাইব্যুনাল। ২৭ নভেম্বর এ আবেদন করেন তিনি।
একই দিন এ মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলামের জেরা শেষ করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। ১৯ নভেম্বর টানা তৃতীয় দিনের মতো তার সাক্ষ্য শেষ হয়। জবানবন্দি শুরু হয় ১২ নভেম্বর। সবমিলিয়ে ২৩ কার্যদিবসে ২৬ জনের সাক্ষ্য-জেরা সম্পন্ন হয়।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চানখারপুল এলাকায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালায় পুলিশ। এতে বহু হতাহতের ঘটনার পাশাপাশি শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক নিহত হন।
