নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ রূপে ডেঙ্গু

* জমে থাকা পানিতে মশার লার্ভা বাড়ছে * নাসিকের ২৭ ওয়ার্ডের অন্তত ২০টিতে ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে ছড়িয়েছে * ‘প্লাটিলেট’ মেশিন সংকটে বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি

প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মোশতাক আহমেদ শাওন, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গু রোগ মহামারির আকারও ছাড়িয়ে গেছে। শহর ও শহরতলীর ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। খোদ সরকারি দুটি হাসপাতালেই মশার উৎপাত। ডেঙ্গু ওয়ার্ডে প্রচণ্ড গরম। গত একমাসে শহরের দেওভোগ লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়া, নন্দীপাড়া, জিউসপুকুর পাড়ের ভূঁইয়ার বাগ এলাকায় স্কুল ছাত্রী ও অভিভাবকসহ ৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে ডেঙ্গুজ্বরে। শহরতলীর পশ্চিম দেওভোগ বাংলাবাজার, কাশীপুর, মাসদাইর, ভোলাইল ও বারৈভোগ এলাকায় প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর শোক সংবাদ প্রচার হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ শহর এখন ডেঙ্গুর তীব্র প্রকোপে বিপর্যস্ত।

শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষা এই শিল্পনগরীতে এ পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের করিডরগুলো রোগী-ভর্তি হয়ে গেছে। শহরের দুটি হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগী সামলাতে পারছে না। অনেক রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিম্বা মহাখালীতে ডিএনসিসি ডেঙ্গু হাসপাতালে রেফার হয়ে চলে যাচ্ছে। যাদের প্লাটিলেট কমে যায় তাদের ঢাকায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

সর্বত্রই একটাই আলোচনা- কে কবে মারা গেলেন, কার ছেলেটা হাসপাতালে ভর্তি, কার মেয়েটার প্লাটিলেট নেমে গেছে। ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়। বরং এ শহরে তা মহামারির সীমাও ছাড়িয়ে গেছে। খোদ সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডেই মশার উৎপাত, রোগীরা শ্বাস নিতে পারছেন না গরমে।

দেওভোগ লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়ার বাড়ির উঠানে বসে ছিলেন অঞ্জলি সাহা। তার চোখ দুটো ফুলে গেছে কান্নায়। অঞ্জলির ১৪ বছরের মেয়ে অনামিকা সাহা ক্লাস এইটে পড়তো। গত ৭ সেপ্টেম্বর তাকে জ্বর নিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল ৩০০ শয্যা হাসপাতালে। প্লাটিলেট দ্রুত কমতে থাকায় ডাক্তাররা তাকে ঢাকায় রেফার করেন। কিন্তু ঢাকা নেওয়ার আগেই অনামিকা মারা যায়।

একই সময়ে নন্দীপাড়ার জহির উদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে আশিক (১৯) মারা গেছে ডেঙ্গুতে। তার বাবা বললেন, আমরা ভেবেছিলাম জ্বর হয়েছে। দুইদিন পর রক্ত পড়তে শুরু করল। হাসপাতাল বলল, প্লাটিলেট নামছে। ঢাকায় নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স খুঁজতে খুঁজতেই ছেলেটা শেষ। এভাবে ভূঁইয়ারবাগ থেকে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলরও স্বীকার করেছেন, এক মাসে শুধু ওই এলাকা থেকেই ৮-৯ জন মারা গেছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেনারেল হাসপাতাল (ভিক্টোরিয়া) নারায়ণগঞ্জের করিডরের একপাশে স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন রোগী। কেউ স্যালাইন নিচ্ছেন, কেউ শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছেন। বেডে জায়গা না থাকায় অনেককে মেঝেতেই শোয়ানো হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে অবস্থার আরও করুণ চিত্র। গরমে ঘেমে ভিজে যাচ্ছে রোগী-স্বজন। অথচ হাসপাতালের ভেতরেই মশা ওড়ে। ডেঙ্গু ওয়ার্ডে শোবার সময় রোগীদের হাতে পাখা নিয়ে মশা তাড়াতে দেখা গেছে স্বজনদের। তবে চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। একজন রোগীর মা বললেন, ডাক্তাররা বলছে ঢাকায় নেন। কিন্তু ঢাকা নেব কীভাবে? অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। ভাড়া ৪-৫ হাজার টাকা চায়। গরিব মানুষ টাকা পাবে কোথায়। সিভিল সার্জন ডা. এএফএম মুশিউর রহমান জানান, নারায়ণগঞ্জে কোনো হাসপাতালে প্লাটিলেট কাউন্ট ও সেপারেশন মেশিন নেই। এ কারণে জটিল অবস্থার রোগীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ভয়াবহ হারে বেড়েছে। প্রতিদিন সদর হাসপাতাল ও ৩০০ শয্যা হাসপাতালে মিলিয়ে অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ রোগী ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু বেড সীমিত। তাই অনেককে ঢাকায় পাঠাতে বাধ্য হচ্ছি।

রোগীরা বলছে, ঢাকা যেতে গিয়ে অনেক সময় প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। প্লাটিলেট কমে যাওয়ার পর প্রতিটি মিনিট মূল্যবান। কিন্তু রেফারের ঝুঁকি আর যাতায়াতের কারণে অনেকের জীবন বাঁচানো যাচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জের চিকিৎসক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ এখন এককথায় বলছেন প্লাটিলেট মেশিন চাই। এই মেশিন থাকলে দাতার রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করে সরাসরি রোগীকে দেওয়া সম্ভব। যা ডেঙ্গুর জটিল পর্যায়ে জীবন বাঁচানোর অন্যতম উপায়। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ২৭টি ওয়ার্ডের অন্তত ২০টিতে ডেঙ্গু ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন ওষুধ ছিটানোর কাজ চলছে বললেও স্থানীয়রা বলছেন, তা অকার্যকর।

বাংলাবাজারের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন অভিযোগ করলেন, ‘ওরা ফগিং করে, কিন্তু তার কোনো প্রভাব নেই। দুই ঘণ্টার মধ্যেই মশা আবার ভনভন করে। আরেকজন যোগ করলেন, ফগিং হচ্ছে লোক দেখানো। ড্রেনের ভেতরে পানি জমে আছে, লার্ভা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই।’ এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর জটিল অবস্থায় রোগীর শরীরে প্লাটিলেট কমে যায়, যা রক্তক্ষরণ ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন একমাত্র কার্যকর সমাধান। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি হাসপাতালে এই সুবিধা থাকলেও নারায়ণগঞ্জে একটিও নেই। প্রতিদিন অন্তত ১৫-২০ জন রোগীকে মেশিন না থাকায় ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, একটি প্লাটিলেট সেপারেশন আধুনিক মেশিনের মূল্য প্রায় ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা, বাজেট সীমাবদ্ধতা ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এই মেশিন এখনও কেনা হয়নি। জেলা সিভিল সার্জন দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা বারবার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। প্রক্রিয়া চলছে।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বললেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় সবরকম প্রস্ততি রয়েছে জেলার প্রশাসনের। বর্তমান এ পরিস্থিতি দ্রুত স্বল্প সময়ের মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি প্লাটিলেট সেপারেশন মেশিনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।