বসন্তের বার্তা

প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  হাবীবুল্লাহ সিরাজ

প্রকৃতির বৈচিত্র্য উৎসব আল্লাহর নিদর্শন। এই বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে মাটি থেকে অঙ্কুর ওঠে। নতুন নতুন চারা গজায়। গাছে গাছে নতুন পাতার হিল্লোল জাগে। আকাশে-বাতাসে ফাগুন আসে। প্রকৃতির শাখে শাখে আগুনরাঙা অশোক পলাশ-শিমুল ফোটে। ফুলে ফুলে মৌমাছির ব্যস্ত ওড়াউড়ি দেখতে পাই। পাতার আড়ালে কোকিলের ব্যাকুল কুহুতান শোনা যায়। দিগন্তজুড়ে সরিষা ফুলের বিস্তৃত হলুদ চাদর হেসে ওঠে। ফাগুনের আগুন রঙে সাজতে শুরু করে প্রকৃতি। প্রকৃতির এ পরিবর্তন বসন্তের আগমনী বার্তা। জনজীবনে এলো প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় বাসন্তী দোলা। মানুষ সাজছে নতুন প্রত্যয়ে, নতুন মোহে। প্রকৃতির এ বিবর্তনের গল্প আল্লাহতায়ালা কোরআনেও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘তিনিই (আল্লাহ) স্বীয় অনুগ্রহের প্রাক্কালে সুবার্তাবাহী বায়ু প্রেরণ করেন (প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটান) এবং আমি (আল্লাহ) আকাশ থেকে পবিত্র (ও পবিত্রকারী) পানি বর্ষণ করি, যা দ্বারা আমি মৃত ভূমিকে জীবিত করি। আমার সৃষ্টির বহু জীবজন্তু ও মানুষকে তা পান করাই।’ (সুরা ফোরকান : ৪৮-৪৯)। অন্য আয়াতে বলেন, ‘আল্লাহ দিনরাত তথা প্রকৃতির মাঝে বৈচিত্র্যের সমাহার ঘটান। তাতে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের জন্য চিন্তার উপকরণ রয়েছে।’ (সুরা নুর : ৪৪)।

ফাগুনের আগমন কেন?

দিনরাতের আগমন প্রত্যাগমের সঙ্গে পৃথিবীজুড়ে ঋতুর পরিবর্তন সাধিত হয়। প্রকৃতির এ পরিবর্তনের ছোঁয়ায় একেক অঞ্চল একেকভাবে সেজে ওঠে। আল্লাহর সুনিপুণ কৌশলের কারণে এক আকাশের নিচে একই জমিনে আমরা হাজারো বৈচিত্র্যসুখ ভোগ করি। পৃথিবীজুড়ে একই পানি, একই বাতাস। কিন্তু স্বাদে-গন্ধে ভিন্ন। বৈচিত্র্য স্বাদের এ নেয়ামতধারাকে আল্লাহ বান্দার মাঝে স্থায়ী করতে দান করেন ফাগুনের আগুন। তাই কৃতজ্ঞতা আদায়ের মাধ্যমে ফাগুনকে বরণ করা কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘জমিনে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন ভূখ-। আঙুর বাগান, শস্যক্ষেত্র, একই মূল থেকে উদ্গত বা ভিন্ন ভিন্ন মূল থেকে উদ্গত খেজুর গাছ। যেগুলো একই পানি দ্বারা সেচ করা হয় (অথচ স্বাদে রসে ঘ্রাণে ভিন্ন ভিন্ন)।’ (সুরা রাদ : ৪)।

যদি ফাগুন না হতো

যদি নিয়ম করে প্রকৃতিতে না জাগত ফাগুনের আগুন? যদি পরিবর্তন না হতো শীত, বর্ষা, গরম, গ্রীষ্মের! তাহলে পৃথিবী হুমকির মুখে পড়ত। যদি রাতের পরিমাণ বেশি হতো, তাহলে পৃথিবী আস্তে আস্তে শীতল হয়ে বরফে ঢেকে যেত। আবার যদি দিনের পরিমাণ বাড়তে থাকত, তাহলে পৃথিবী ধীরে ধীরে গরম হয়ে উত্তর-দক্ষিণ মেরুর বরফ গলতে শুরু করত, সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যেত। ফলে বেশির ভাগ দেশ সাগরে ভেসে যেত। দিনের আলো না থাকলে কোনো উদ্ভিদ বেঁচে থাকত না। কোনো উদ্ভিদ না থাকলে কোনো প্রাণী বেঁচে থাকত না। প্রকৃতিতে ফাগুনের আগমন মূলত আমাদের খাদ্য নিশ্চিতকরণ ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরিকরণের জন্যই। যদি প্রকৃতির এ পরিবর্তন না থাকত, তাহলে উদ্ভিদ ও জীবজগত টিকে থাকত না। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি ও এতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি। আমি পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তু সুপরিকল্পিতভাবে উৎপন্ন করেছি। আমি তোমাদের জন্য তাতে জীবিকার ব্যবস্থা করেছি তোমরা যাদের রিজিকদাতা নও, তাদের জন্যও। প্রতিটি বস্তুর ভান্ডার আমার কাছে আছে। আমি তা প্রয়োজনীয় পরিমাণেই সরবরাহ করে থাকি। আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি। অতঃপর আকাশ থেকে বারিধারা বর্ষণ করি। তা তোমাদের পান করতে দিই। বস্তুত এর ভান্ডার তোমাদের কাছে নেই।’ (সুরা হিজর : ১৯-২২)।

বসন্ত বরণ হোক আল্লাহর কৃতজ্ঞতার মাধ্যমে

ফাগুন এলেই নগরজুড়ে ফুল ও পোশাকের বাহারি বেশ দেখা যায়। অপরাপর অনেক সংগঠন বসন্তকে ঘিরে নানা আয়োজন করে থাকে। কিন্তু আফসোস, একটি অনুষ্ঠানেও বসন্তের শিক্ষা থাকে না। ফাগুনকে ভিন্নধারায় প্রবাহিত করা হয়। জবা, বেলি, কাঞ্চন মাথায় গোঁজা আর বাহারি রঙের শাড়ি, রঙিন শার্ট-পাঞ্জাবি পরা ফাগুনের বরণ নয়। মূলত এগুলো ফাগুনের সঙ্গে তথা প্রকৃতির এ বিবর্তনের তামাশা করার শামিল। আমরা প্রকৃতির এ পরিবর্তনে উল্লাসে মেতে উঠি। হেসে নেচে গেয়ে রূপবৈচিত্র্যের শিক্ষাকে ভুলে যাই। অথচ আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘দিনরাতের পরিবর্তনের (প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যের) মাঝে তোমরা চিন্তা করো না কেন? এতেই রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্য নির্দশন। (সুরা মোমিনুন : ৮০)।

নতুন প্রত্যয়ে জীবন সাজানো ফাগুনের শিক্ষা

প্রকৃতির এই সুন্দর পরিবেশ, স্বাস্থ্যসম্মত আবহাওয়া, স্বচ্ছ শীতল সমীরণ আল্লাহর অফুরান অনুগ্রহ। তাই এগুলোর সর্বোচ্চ ভালো ব্যবহার নিশ্চিত করা মোমিন জীবনের কর্তব্য। নতুনের মহিমায় পবিত্রতার আবহে নিজেকে সংশোধন করা, পুরোনো পাপ-তাপ ধুয়ে-মুছে নতুন প্রত্যয়ে জীবন সাজানো ফাগুনের শিক্ষা। শিমুল-জবা যেমন শীতের আর্দ্রতায় নিজের পুরোনো পাতা ঝেড়ে ফেলে ফাগুনের নয়া পত্রপল্লবিত জাগে, তেমনি মোমিনও তার জীবন-মানচিত্রে পুরোনো পাপের সীমা উপড়ে ফেলে নতুন সীমানায় প্রবেশ করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই রাতদিনের (প্রকৃতি, ঋতু ও জোয়ার-ভাটার) পরিবর্তনে এবং আসমান-জমিনে আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তাতে আল্লাহভীরুদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা ইউনুস : ৬)।

লেখক : শিক্ষাসচিব, বাইতুল মুমিন মাদ্রাসা, উত্তরা, ঢাকা

খতিব, করিমহাজি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা