ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পরিবেশ সংরক্ষণে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

পরিবেশ সংরক্ষণে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী; নন্দিত টিভি উপস্থাপক ও প্রখ্যাত আলোচক। ধর্মীয় নানা ইস্যুতে জাতীয় দৈনিকে কলাম লেখেন নিয়মিত। রচনা করেছেন ১২টি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি নামক সংগঠন। পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার বিষয়ে বরেণ্য এ আলেমের সঙ্গে কথা বলেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহসম্পাদক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

বনভূমি রক্ষায় ইসলাম কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে?

অপার সৌন্দর্যময় এই নিখিল বিশ্বের রাজাধিরাজ আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে যেসব মাধ্যম সৃষ্টি করেছেন, বন বা বনাঞ্চল তার অন্যতম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো তো! নভোম-ল ও ভূম-ল কে সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য কে পানি বর্ষণ করেছেন? অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান (বন) সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা নাহল : ৬০)। গাছ প্রকৃতির অপূর্ব শোভা। গাছহীন পৃথিবী মলিন। গাছ মানুষসহ সব প্রাণীর বন্ধু। যে অঞ্চলে যত বেশি গাছপালা, সে অঞ্চল তত বেশি প্রাণবন্ত। গাছ অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি রোধ করে। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা কমায় এবং শীতকালে বাড়ায়। জলাবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার অন্যতম হাতিয়ার বনায়ন। সে জন্যই রাসুল (সা) বৃক্ষরোপণের জন্য সাহাবিদের উৎসাহিত করেছেন। তিনি বৃক্ষরোপণ ও ফসল বপনকে ‘সদকায়ে জারিয়া’ বলেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলিম যদি বৃক্ষরোপণ করে বা খাদ্যশস্যের বীজ বপন করে, অতঃপর তা থেকে কোনো মানুষ, পাখি বা পশু কিছু খায়, তবে তার জন্য এ কাজ সদকা হিসেবে বিবেচিত হবে।’ (বোখারি : ৫১৩)।

আমাদের দেশে যেভাবে গাছ কাটা হচ্ছে, এটাকে কীভাবে দেখছেন?

এটা খুবই আফসোসের কথা, প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ এই গাছ কেটে আমরা পৃথিবীটাকে বসবাসের অযোগ্য করে ফেলছি। পরিবেশবিদদের মতে, একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে সে দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ আমাদের দেশের বনভূমির পরিমাণ মোট ভূমির ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। এ জন্যই তো আমাদের দেশের আবহাওয়া ভারসাম্য হারিয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বৃষ্টিপাত কমে যায়। মরুকরণ প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। এসব অন্যায় রোধের সময় এখন। আগামী প্রজন্মকে বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দিতে গাছ না কেটে বেশি বেশি রোপণ করা চাই। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষরোপণ করে, আল্লাহতায়ালা এর বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিদান দান করবেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩৫৬৭)। বৃক্ষ আমাদের পরিবেশের বিশাল অংশজুড়ে বিস্তৃত। বৃক্ষ আমাদের জীবনোপকরণ সামগ্রীর একটি উৎসও বটে। প্রকৃতির এই সুন্দর দৃশ্য আমরা উপভোগ করি বৃক্ষের অবদানে, যা আল্লাহর অশেষ দান। যে বৃক্ষ আমদের নিঃশ্বাস গ্রহণে অনেক অবদান রাখে, তার সঙ্গে আমাদের আচরণ কত নীচু! মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য কলঙ্কের ব্যাপার এটা। বৃক্ষের নিচে আমরা দাঁড়িয়ে একটু ছায়া গ্রহণ করি। বৃক্ষের এ ছায়া না হলে আমাদের জীবন কতই না দুর্বিষহ হতো। কল্পনা করতেই গা শিউরে ওঠে। উপকারের প্রতিদান উপকার করা। আমরা জানি; কিন্তু বাস্তবায়ন করতে কেন যেন রাজি নই। আমরা বৃক্ষের কোনো যতœ নিই না। আরও মন্দ ব্যাপার হলো, আমরা বৃক্ষের নিচে বিশ্রাম শেষে ছায়া গ্রহণের পরে খাবারের প্যাকেট, ময়লা-আবর্জনা, বর্জ্য ফেলে রাখি। আমাদের তো বৃক্ষের শিকড়ে পানি সিঞ্চন করা ও আশপাশ পরিষ্কার রাখা উচিত ছিল। যেন অন্য কেউ এসে আরাম করতে পারে। কখনও তো সেখানেই মলত্যাগ করে বসি। আমাদের আচরণ আমাদেরই তখন ধিক্কার জানায়। অথচ রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তিনটি অভিশপ্ত স্থান থেকে বেঁচে থাকো মানুষের সমাগমের স্থানে, পথের মাঝে এবং গাছের ছায়ার নিচে মলত্যাগ করা থেকে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৬)।

সম্প্রতি এক গবেষণায় বিশে^র বায়ু দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথমে। এই বায়ু দূষণ রোধে ইসলাম কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়?

এটা সত্যিই আমাদের জন্য অপমানজনক এবং একই সঙ্গে খুবই উদ্বিগ্নের ব্যাপার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুদূষণ হলো একটি নীরব প্রাণঘাতী সমস্যা। ফুসফুস ক্যান্সারের ২৭ শতাংশ হয় বায়ুদূষণের কারণে। হৃদরোগের ২৫ শতাংশ, শ্বাসকষ্টজনিত রোগের ৪৩ শতাংশের জন্য দায়ী এই বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ মূলত আমাদের অসচেতনতার কারণেই বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের বহুগুণ বৃদ্ধিই বায়ুদূষণ বৃদ্ধির কারণ। এই দূষণ রোধে ইসলামের সুন্দর একটি পদক্ষেপ আছে। তা হলো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা। ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ঈমানের অংশ বলে গণ্য। তাই আমাদের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে আমাদের পরিবার থেকেই। আমাদের নিয়মিত গাড়ি সার্ভিসিং করাতে হবে। লঞ্চের ডেকসহ যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে। অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ না করা এবং ইটের বিকল্প ব্লক ব্যবহার ও পরিকল্পিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধমে বায়ুদূষণ রোধ করতে হবে। আমরা আমাদের সন্তানদের স্বপ্ন দেখাই সম্পদশালী হয়ে দামি গাড়ি কেনার, বড় বাড়ি বানানোর। কিন্তু তাদের পরিবেশবান্ধব দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাই না। বিশ্বাস করি, সবাই এ ব্যাপারে সচেতন হলে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে, ইনশাআল্লাহ। আর যদি অসচেতন হই, তাহলে করোনার মতো বা তার চেয়েও বড় কোনো বিপদ আমাদের মাথায় চেপে বসবে। আল্লাহ সাবধান করে বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে এনো না।’ (সুরা বাকারা : ১৯৫)।

দিন দিন বাড়ছে শব্দদূষণের মাত্রা; মানুষ হয়ে উঠছে অসহ্য ও অসুস্থ। এর প্রতিকারে ইসলাম কী বলে?

ইসলামে শব্দদূষণ খুবই নিন্দনীয় একটি কাজ। এ থেকে বিরত থাকার জন্য রয়েছে কঠোর নির্দেশনা। কেননা, শব্দদূষণের ফলে আমাদের শ্রবণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে, বধিরতা বাড়ছে। হৃদরোগ সৃষ্টিসহ শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘœতা ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাসহ আরও নানাবিধ সমস্যা হচ্ছে। এই দূষণ হওয়ার পেছনে দায়ী হলো, যানবাহনের উচ্চ হর্নের শব্দ, মিল-ফ্যাক্টরির ইঞ্জিনের শব্দ, ওয়ার্কশপের দোকানে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, উড়োজাহাজের শব্দ, অফিস-আদালত ও দোকানপাটে উচ্চ শব্দ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইক ও স্পিকার বাজানোর মাত্রাতিরিক্ত শব্দ। অথচ কথা বলার শব্দও যেন উচ্চ না হয়, সে ব্যাপারেও ইসলামের রয়েছে নির্দেশনা। আবু সাঈদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) মসজিদে ইতেকাফ অবস্থায় ছিলেন। তখন সাহাবিদের উচ্চৈঃস্বরে কোরআন তেলাওয়াত শুনতে পেয়ে তিনি নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তোমরা প্রত্যেকেই আল্লাহতায়ালার পরিবেশের অনুগত। সুতরাং একে অপরকে কষ্ট দেবে না এবং কোরআন পাঠ বা নামাজ পড়ার সময় একে অপরের তুলনায় স্বর উঁচু করবে না।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১১৩৫)। ইবাদতের ক্ষেত্রেও ইসলাম শব্দকে উঁচু করতে বারণ করেছে। উচ্চ শব্দ মানুষের কষ্টের কারণ। আর আল্লাহ চান না তাঁর বান্দারা কষ্ট পাক। যারা মানুষকে কষ্ট দেয়, তারা জালেম। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত