ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসলামে যুদ্ধনীতি ও বর্তমান বিশ্ব

ইসলামে যুদ্ধনীতি ও বর্তমান বিশ্ব

মানবতার প্রতি জঘন্যতম একটি অপরাধ যুদ্ধ-বিগ্রহ। যুদ্ধ মানেই বিভীষিকা, মৃত্যু, ধ্বংস ও অশান্তি। ইসলামে মৌলিককভাবে সকল যুদ্ধবিগ্রহ ফেতনা ফ্যাসাদকে হারাম ঘোষণা করেছে। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ফেতনা-ফ্যাসাদ দূর করার জন্য শর্ত সাপেক্ষে ইসলাম যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছে, শর্তগুলো বিদ্যমান পাওয়া গেলেই যুদ্ধ করা যাবে। এসব শর্তের মধ্যে প্রথমত রয়েছে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্ন ও রাষ্ট্র প্রধানের অনুমতি। রাসুল (সা.) বলেন, ‘রাষ্ট্রপ্রধান হলো ডাল, যাকে সামনে রেখে যুদ্ধ পরিচালিত হবেঅ’ (বোখারি- ২/৫৫৩)। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র অনিরাপদ পরিস্থিতি বা হুমকির সম্মুখীন হলে। অর্থাৎ শত্রুপক্ষ আক্রমণ করবে বা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নাগরিক নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হলে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধনীতির অনুমোদন দেয় ইসলাম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে।’ (সুরা হজ্জ : ৩৯)।

তৃতীয়ত, সন্ধি ও শান্তির সুযোগ গ্রহণ। যেকোনো ধরনের যুদ্ধই ধ্বংস ও অশান্তি সৃষ্টির পথ। মানবজাতিকে যাতে ধ্বংস ও সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়, সে জন্য ইসলাম যুদ্ধ-পূর্বে সন্ধি বা শান্তি চুক্তির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তারা যদি সন্ধির প্রতি ঝুঁকে পড়ে, তবে তুমিও তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়। আর আল্লাহর ওপর নির্ভর কর। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’ (আনফাল : ৬১)। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে হুদাইবিয়ার সন্ধির ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ, দাওয়াতের প্রসার ও দিনের বিজয়ে সন্ধির অবদান ছিল অনেক বেশি। যদিও বাহ্যিক বিচারে এই সন্ধি ছিল একটু অপমানজনক ও শত্রুপক্ষকে ছাড় দেওয়া; কিন্তু এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ইসলামে কোনো যুদ্ধ, জিহাদ বা অভিযানকে ‘ফাতহুম মুবিন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় বলা হয়নি; অথচ হুদাইবিয়ার সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় বলে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।

চতুর্থ, যোদ্ধাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা। অর্থাৎ যদি যুদ্ধ করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ না থাকে তাহলে যুদ্ধের ময়দানে যোদ্ধাদের সঙ্গেই বা যারা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে সামনে আসে তাদের সঙ্গেই যুদ্ধ করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের সঙ্গে, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না। আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা বাকারা : ১৯০)।

এখানেও ইসলাম ন্যায়সংগত যুদ্ধ করার কথা বলে। জনগণের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের নিমিত্তে মাতৃভূমিকে বহিঃশত্রু ও অভ্যন্তরীণ শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য জানমাল ও জ্ঞান বুদ্ধি দ্বারা যে সংগ্রাম করা হয় সেটাই ন্যায়সংগত যুদ্ধ। ইসলাম প্রয়োজন সাপেক্ষ যেমন ন্যায়সংগত যুদ্ধের স্বীকৃতি দিয়েছে, তেমনি শান্তি চুক্তি বা সন্ধির বিধানের প্রতি গুরুত্বারোপ করে উৎসাহিত করা হয়েছে, যাতে যুদ্ধ নামক বিভীষিকাময় কাঁটার আঘাতে মানুষকে ক্ষতবিক্ষত না হতে হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফেতনা দূর হয়।’ (সুরা বাকারা : ১৯৩)।

ইসলাম সবধরনের সামরিক আগ্রাসন, নাগরিকদের ওপর বোমা নিক্ষেপ, চরমপন্থা, গণহত্যাবিরোধী। যুদ্ধক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে সাধারণ নাগরিক, নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধে তোমরা প্রতারণা বা ধোঁকার আশ্রয় নেবে না, চুক্তিভঙ্গ করবে না, কোনো মানুষ বা প্রাণীর মৃতদেহ বিকৃত করবে না বা অসম্মান করবে না, কোনো শিশু-কিশোরকে হত্যা করবে না, কোনো মহিলাকে হত্যা করবে না, কোনো গির্জাবাসী, সন্ন্যাসী বা ধর্মযাজককে হত্যা করবে না, কোনো বৃদ্ধকে হত্যা করবে না, কোনো অসুস্থ মানুষকে হত্যা করবে না, কোনো বাড়িঘর ধ্বংস করবে না, খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া গরু, উট বা কোনো প্রাণী বধ করবে না, যুদ্ধের প্রয়োজন ছাড়া কোনো গাছ কাটবে না। তোমরা দয়া ও কল্যাণ করবে, কারণ আল্লাহ দয়াকারীÑ কল্যাণকারীদের ভালোবাসেন।’ ( আসসুনানুল কুবরা - ৯/৯০)।

ইসলামে সামরিক যুদ্ধনীতি আক্রমণাত্মক নয়; বরং আত্মরক্ষামূলক। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দেশে যে যুদ্ধ হচ্ছে, তার প্রায় সবগুলোই আক্রমণাত্মক যুদ্ধ। সামরিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থ ও আধিপত্য দেখানোর লক্ষ্যে আগ্রাসী যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আক্রান্ত রাষ্ট্রকে কোণঠাসা করে ফেলছে। এতে সাধারণ নাগরিকদের জীবন বিষণœ হয়ে উঠছে, যা বড় ধরনের মানব অপরাধ। ইসলাম এমন সব কার্যক্রমকে কঠোরভাবে নিষেধ করে। যুদ্ধ যেমন আক্রান্ত জাতি-গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে বিপন্ন করে, তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করে এবং পৃথিবীর অন্য ভূখ-ে বসবাসরত মানুষের জীবনকেও সংকটময় করে তোলে। তাই সব রাষ্ট্রকে এসব জঘন্যতম মানব অপরাধ থেকে বিরত থাকা উচিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত