প্রিয়নবি রাসুলে আকরাম (সা.) এর বহু হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত ও প্রমাণিত হয়েছে যে, শরীরে ট্যাটু করা বা উল্কি অঙ্কন করা হারাম, কবিরা গোনাহ (বড় পাপ)। পাশাপাশি এটি অমুসলিমদের সঙ্গেও সাদৃশ্য অবলম্বনের অন্তর্ভুক্ত। সেই সঙ্গে এটি মহান আল্লাহর অপার সৌন্দর্যকে কৃত্রিমভাবে আল্লাহর সৃষ্টিগত সৌন্দর্য বিকৃতির শামিল, যা চরম অন্যায় ও গর্হিত কাজ। তাই নারী-পুরুষ সকলের জন্য শরীরে ট্যাটু বা উল্কি অঙ্কন করা, করিয়ে নেওয়া, এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা এবং এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা, এটার ব্যাবসা করা, ইউটিউব বা অনলাইন-অফলাইনে এগুলো মানুষকে শেখানো বা প্রচার করা এককথায় এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কাজ সম্পূর্ণরূপে হারাম ও মারাত্মক অপরাধের শামিল।
ট্যাটু বা উল্কি আঁকা বিধর্মীদের সংস্কৃতি
ট্যাটু বা উল্কি পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্যতম, যা আমাদের দেশসহ পুরো বিশ্বে তরুণ-তরুণীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এটা পশ্চিমা বিশ্বে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এটার মাধ্যমে তারা নিজেদের সৌন্দর্যকে বিকৃত করে। সেই সঙ্গে কোনো মুসলমান ট্যাটুতে যদি অমুসলিমদের ধর্মীয় প্রতীক, প্রাণীর ছবি, ড্রাগনের মাথা, প্রাণীর কার্টুন, নারী-পুরুষের ছবি, বয়ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ডের নাম, অশ্লীল বাক্য ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় অথবা বিপরীত লিঙ্গের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ট্যাটু করা হয়, তখন তার গোনাহ ও ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পায়। একজন মুসলমান হয়ে বিধর্মীদের সংস্কৃতির অনুকরণ করা মানে তাদের দলভুক্ত হয়ে যাওয়া যা হাদিস শরিফে নবীজি কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হয়। (আবু দাউদ : ৪০৩১)।
ইসলামি নিদর্শনগুলোর উল্কি আঁকা মারাত্মক অপরাধ
বর্তমানে কিছু মুসলিম তরুণ-তরুণী যারা পশ্চিমা খ্রিস্টানদের কৃষ্টি-কালচার এবং তাদের অপসংস্কৃতি ধারণ করে, তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে কালেমা, আল্লাহ, রাসুল, কাবা শরিফ, মসজিদে নববি ইত্যাদি ইসলামি নির্দশনের ট্যাটু অঙ্কন করে এটিকে হালাল করার অপচেষ্টা করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটিও অত্যন্ত গর্হিত কাজ ও ইসলামের প্রতি ধৃষ্টতার শামিল। পবিত্র স্থান এবং চিহ্নগুলো শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অঙ্কন করে এর মাধ্যমে ইসলাম ও কালেমার সম্মানহানি করা, ইসলামের সঙ্গে চরম অন্যায় ও অমানবিক আচরণ, যা কোনো মুসলমান দেখতে ও সহ্য করতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, বর্তমানে অনেক মুসলিম তরুণ-তরুণী তথাকথিত ফ্যাশন হিসেবে শরীরে উল্কি অঙ্কন বা ট্যাটু করছে, অনেকে রীতিমতো এ কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছে। অথচ এ কাজ করা যেমন হারাম, তেমনি এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া এবং এই পেশা থেকে উপার্জিত অর্থও হারাম।
কোরআনুল কারিমের আলোকে ট্যাটু বা উল্কি আঁকার পরিণাম
আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম কাঠামো দিয়ে।’ (সুরা তিন : ০৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তারা আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি করবেই।’ (সুরা নিসা : ১১৯)। আল্লাহপাক আরও বলেন, ‘তারা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে শুধু নারীর আরাধনা করে এবং শুধু অবাধ্য শয়তানের পূজা করে। যার প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন। শয়তান বলল, আমি অবশ্যই আপনার বান্দাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে অবলম্বন করব। তাদের পথভ্রষ্ট করব, তাদের আশ্বাস দেব; তাদের পশুদের কর্ণ ছেদন করতে বলব এবং তাদের আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ দেব। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়।’ (সুরা নিসা : ১১৭-১১৯)।
আল্লাহপাক আরও এরশাদ করেন, ‘যখন আল্লাহ ও তার রাসুল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন, তখন কোনো মোমিন পুরুষ ও মোমিন নারীর সেই ব্যাপারে নিজে ফায়সালা করার কোনো অধিকার তাদের নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তার রাসুলের অবাধ্য হয়, সে সুস্পষ্ট ভ্রষ্টতায় লিপ্ত হয়।’ (সুরা-আহজাব : ৩৬)।
হাদিসের আলোকে উল্কি আঁকার পরিণাম
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যেসব নারী নকল চুল ব্যবহার করে এবং যারা অন্য নারীকে নকল চুল এনে দেয়, যেসব নারী উল্কি অঙ্কন করে এবং যাদের জন্য করে, রাসুল (সা.) তাদের অভিশাপ দিয়েছেন। (বোখারি : ৫৫৯৮, মুসলিম : ৫৬৯৩)।
অপর হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যেসব নারী সৌন্দর্যের জন্য উল্কি অঙ্কন করে এবং যাদের জন্য করে, যেসব মহিলা ভ্রু উৎপাটন করে এবং দাঁত ফাঁকা করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের অভিসম্পাত করেছেন। (বোখারি : ৫৬০৪)।
উল্কির কারণে অজু-গোসল শুদ্ধ হয় না
উল্কির কারণে চামড়া পর্যন্ত পানি পৌঁছাতে যদি বাধার সৃষ্টি হয়, তাহলে অজু আদায় হবে না। আবার ফরজ গোসলও সম্পন্ন হবে না। ফলে সবসময় অপবিত্র শরীর নিয়ে বয়ে বেড়াতে হবে। তাই শরীরে উল্কি না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
উল্কি ব্যবহারে স্বাস্থ্যগত অপকারিতা
শরীরে উল্কি আঁকানোর বৈজ্ঞানিক কোনো উপকারিতা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। উল্টো উল্কি ব্যবহারে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রয়েছে। হেপাটাইটিস, টিউবারকিউলোসিস, টিটেনাস ইত্যাদি রোগের সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, উল্কির রংও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কারণ উল্কি আঁকার রাসায়নিক পদার্থ চামড়ার ভেতরের স্তরে প্রবেশ করে। আর যেহেতু এই উল্কি সারাজীবন শরীরে থাকবে, তাই ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থও সারা জীবন দেহে থেকে যাবে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের অসুখ এমনকি ক্যান্সার হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
এফা মারিয়া কাটস নামে একজন গবেষক উল্কির জন্য তৈরিকৃত রঙের রাসায়নিক পদার্থ কতটা ক্ষতিকারক তা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী থেকে শুরু করে উল্কি আঁকার কালি নিয়ে গবেষণা করি। ২০১০ সালে আমরা বেশ কিছু ট্যাটু-পার্লার থেকে প্রায় ৩৮ ধরনের কালি সংগ্রহ করি। অনেক রং বা কালি এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়, যা কোনো প্রাণীর জন্য ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এর মধ্যে একটি পদার্থের নাম এজো ডাই। রংটি এমনিতে কোনো ক্ষতি করে না, কিন্তু অন্য কোনো কিছুর সংস্পর্শে এলে তা অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। এ ছাড়া আরও অনেক রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা ব্যবহারে কোনো নিষেধ নেই। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা মানবদেহে ব্যবহার করা সংগত নয়। এই পদার্থগুলো মানবদেহে ঢুকে কী কী ক্ষতি করতে পারে, তা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।’
ট্যাটু প্রথার বিস্তৃতি এবং রাসুল (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী
সত্যি রাসুল (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করেছিলেন যে, কেয়ামতের আগে এক শ্রেণির মুসলিম ইহুদি-খ্রিস্টানদেরকে প্রতিটি পদে-পদে অনুসরণ-অনুকরণ করবে। এমনকি যদি তারা শান্ডার গর্তে প্রবেশ করে, তারাও তাদের অনুসরণে ওই গর্তে প্রবেশ করবে। (বোখারি ও মুসলিম)।
পরিশেষে মহান আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিনের দরবারে কায়মানো বাক্যে প্রার্থনা করছি, আল্লাহপাক যেন আমাদেরকে এসব অন্যায়, অশ্লীল, গর্হিত ও পশ্চিমা অসংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখেন, আমিন। বেহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালিন (সা.)।
লেখক : সহকারী মাওলানা, চরণদ্বীপ রজভীয়া ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম