ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট ২০২৫, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শবেকদরের কদর করি

মুফতি দিদার শফিক
শবেকদরের কদর করি

লাইলাতুল কদর পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের একটি মহিমান্বিত রাত। এ রাত অল্প সময়ে প্রচুর নেকি লাভের রাত। মুসলমানদের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের এক বিশেষ মুহূর্ত। লাইলাতুল কদর আরবি ভাষার একটি যৌগিক শব্দ। যার অর্থ- ভাগ্যরজনী, সম্মানিত রাত। ভারত উপমহাদেশে এ রাতটি শবেকদর নামে অধিক পরিচিত। এ রাতে বান্দার পরবর্তী এক বছরের নির্ধারিত ভাগ্য ও বিধিলিপি প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আবু বকর ওয়াররাক বলেন, ‘আমলহীনতার কারণে যে ব্যক্তির সম্মান ও মূল্য ছিল না, এ রাতে তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে সে সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়। তাই এ রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয়।’ (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)।

লাইলাতুল কদরের প্রেক্ষাপট

ইবনে আবি হাতেম (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) একবার বনি ইসরাইলের এক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে মুজাহিদ এক হাজার মাসব্যাপী লাগাতার জিহাদে লিপ্ত থাকত। এ দীর্ঘ সময়ে কখনও অস্ত্রবিরতি দেয়নি। মুসলমানরা এ কথা শুনে অবাক হলো। তখন আল্লাহতায়ালা সুরা কদর অবতীর্ণ করলেন। এ সুরায় ঘোষণা করা হলো, উম্মতে মুহাম্মদির জন্য শুধু এক রাতের ইবাদতই সে মুজাহিদের অবিরাম এক হাজার মাস ইবাদতের চেয়ে উত্তম। (তাফসিরে মাজহারি)।

লাইলাতুল কদর কখন হয়?

রমজানের শেষ দশকের যে কোনো বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শেষ দশকের কোনো এক বেজোড় রাত তথা বেজোড় তারিখের পূর্ববর্তী দিন শেষে সূর্যাস্তের পর থেকে ফজর পর্যন্ত সময়টুকু লাইলাতুল কদর বলে গণ্য হয়। এ সময় ফেরেশতারা সর্বপ্রকার শান্তি ও কল্যাণকর বিষয় নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন। (সুরা কদর : ৪-৫)।

কদরের তারিখ পরিবর্তনশীল

শবেকদর বা লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে ঘূর্ণায়মান। প্রতি রমজানে তা পরিবর্তনশীল। অধিকাংশ ইমাম এ মতই ব্যক্ত করেছেন। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)।

২৭ রমজান শবেকদর নির্ধারিত নয়

রমজানের সাতাশ তারিখে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পাক-ভারত উপমহাদেশে শবেকদর উদযাপিত হয়। সাতাশ তারিখেই শবেকদর হবে, হাদিসের ভাষ্যমতে এটা নিশ্চিত নয়। উবাদা ইবনে সামিত (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, একবার রাসুল (সা.) আমাদের লাইলাতুল কদরের (নির্দিষ্ট তারিখ) অবগত করার জন্য বেরিয়েছিলেন। তখন অমুক অমুক ঝগড়া করছিল। ফলে তার (নির্দিষ্ট তারিখ) ভুলিয়ে দেওয়া হয়। হতে পারে এর মধ্যে সবার কল্যাণ রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা (রমজানের শেষ দশ দিনের) নবম (২৯ তারিখ), সপ্তম (২৭ তারিখ) ও পঞ্চম (২৫ তারিখ) রাতে তা তালাশ করো।’ (বোখারি : ২০২৩)।

কোন রাতে শবেকদর খুঁজব?

শবেকদর নির্দিষ্ট কোনো তারিখে হয় না, এতটুকু নিশ্চিত। সামগ্রিকভাবে শবেকদর সম্পর্কিত হাদিসগুলোতে তিন ধরনের নির্দেশনা পাওয়া যায়- এক. রমজানের শেষ দশ দিনের রাতে (জোড়-বেজোড় রাত বিবেচনায় না এনে) শবেকদর তালাশ করা, দুই. শেষ দশকের সব বেজোড় রাতে শবেকদর সন্ধান করা, তিন. জোড়-বেজোড়সহ নির্দিষ্ট কিছু তারিখে বিশেষত ২৪, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখে শবেকদর তালাশ করা। শবেকদর কোন রাতে হয়, এ নিয়ে বিভিন্ন তারিখ ও মত বর্ণিত আছে। তাই এগুলোর মাঝে সমন্বয় করে শবেকদর খোঁজার ও পাওয়ার উত্তম পদ্ধতি হলো, রমজানের শেষ দশকের প্রতি রাতে ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। অন্তত শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবেকদর তালাশ করা চাই। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর (শবেকদর) সন্ধান করো।’ (বোখারি : ২০১৭)। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত আরেক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। বলতেন, তোমরা শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বোখারি : ২০২০)।

শবেকদরের ফজিলত

শবেকদরের ফজিলত অপরিসীম। শবেকদরের এক রাতের ইবাদত শবেকদরহীন হাজার রাতের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। পূর্ববর্তী উম্মত বনি ইসরাইলের বিশেষ নেককার বান্দাদের দিনে অবিরাম জিহাদে ও রাতে ইবাদতে রত থেকে এক হাজার মাস কৃত ইবাদতের চেয়ে শবেকদরের এক রাতের ইবাদত উত্তম। শবেকদরে ইবাদতকারী বান্দার ওপর সন্ধ্যা রাত থেকে ফজর পর্যন্ত শান্তি ও কল্যাণ বর্ষিত হয়। এ সময় যারা ইবাদতে রত থাকেন, তারা এ কল্যাণ অর্জন করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি একে (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি শবেকদরে। শবেকদর সম্পর্কে আপনি কি জানেন? শবেকদর হলো, এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে (এ রাতে) প্রত্যেক কাজের জন্য পালনকর্তার নির্দেশে ফেরেশতারা ও জিবরাইল অবতীর্ণ হয়। এটা শান্তি-নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ (সুরা কদর : ১-৫)।

কদরের বিশেষ আমল ও দোয়া

শবেকদরে নির্দিষ্ট সুরা বা রাকাত সংখ্যার কোনো নামাজ নেই। যত সংখ্যা ইচ্ছে নফল নামাজ পড়া যাবে। এর পাশাপাশি কোরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ পাঠ, তওবা-ইস্তেগফার, গোনাহ মাফের প্রার্থনা, রাসুল (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠ করে এ রাতে ইবাদতে মশগুল থাকা উচিত। যার জন্য যে নফল ইবাদত সহজ হবে, সে সেটা করতে পারবে। তবে আয়েশা (রা.) একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি আমি শবেকদর পাই, তাহলে কী দোয়া করব?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘এই দোয়া পড়ো- আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি।’ (অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা পছন্দ করেন। অতএব, আমাকে ক্ষমা করে দিন)।

শেষ দশকে রাসুল (সা.) ও তার পরিবারের আমল

রমজানের শেষ দশকে রাসুল (সা.) ইতেকাফ করতেন। ইতেকাফের মাধ্যমে ইবাদতে রত থেকে শবেকদর পাওয়া খুব সহজ। রমজানের শেষ দশকে রাসুল (সা.) ও তার পরিবার ইবাদতে বেশ মগ্ন থাকতেন। রাত জেগে ইবাদত করতেন। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রমজানের শেষ দশক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.) সারারাত জেগে থাকতেন। নিজ পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে জাগাতেন। নিজেও ইবাদতের জন্য জোর প্রস্তুতি নিতেন। (মুসলিম : ২৬২৮)।

শেষ দশক ও কদরের আবেদন

রমজানের শেষ দশকে ইবাদতের জন্য নিজেকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য অবসর করে নেওয়া জরুরি। শবেকদরে অযাচিত ও প্রচলিত সামাজিকতা রক্ষার্থে খাবারের আয়োজনকে আবশ্যক করে ইবাদতে মশগুল হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেও ঠিক নয়। রমজানে বিশেষত শেষ দশকে বাহারি আইটেমের খাবার তৈরিতে লিপ্ত থেকে নারীরা ইবাদত করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। এ ব্যাপারে বিশেষ সচেতনতা জরুরি।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত