ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইতিহাসে প্রথম পাপ

কাজী তানভীর
ইতিহাসে প্রথম পাপ

সর্বপ্রথম মানব হজরত আদম (আ.)। আল্লাহতায়ালা তাকে সৃষ্টি করে জান্নাতে রাখলেন। যাবতীয় জ্ঞান দান করলেন। জিন, ফেরেশতাসহ সব সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিলেন। নবী বানালেন। মিলেমিশে জীবনযাপন করতে একজন স্ত্রী সঙ্গী জুড়ে দিলেন। আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন আদমকে সম্মান প্রদর্শন করার। সবাই সে হুকুম মান্য করল; কিন্তু অহংকারী ইবলিস তা মানতে অস্বীকার করল। আল্লাহর নির্দেশকে অমান্য করে সে তার যুক্তির আশ্রয় নিল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন আমি আদমকে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলিস ব্যতীত সবাই সেজদা করল। সে নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ (সুরা বাকারা : ৩৪)।

আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করলেন। আর ইবাদত গুজার ইবলিসকে নির্দেশ অমান্য করার ফলে শয়তান বানিয়ে দিলেন। কাফেরদের দলভুক্ত করে দিলেন। সে আরও বেশি ক্রোধান্বিত হলো। মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করার মিশন শুরু করল। পরিকল্পনা অনুসারে, ইবলিস আদম ও হাওয়া (আ.)-কে প্ররোচিত করল। আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারায় সেই কথাটি উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি বললাম হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং সেখান থেকে যা ইচ্ছা তাই খাও। কিন্তু এই বৃক্ষের কাছে যেও না, অন্যথায় তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা বাকারা : ৩৫)। তারা ইবলিসের ধোঁকায় পড়ে নিষিদ্ধ ফল খেল। ফলে উভয়ই জান্নাতের নিবাস হারাল।

আসমান থেকে নেমে তারা জমিনে বসবাস করতে শুরু করল। আল্লাহর রহমতে তাদের সন্তানসন্ততি হলো। তখন হাওয়ার (আ.) গর্ভে সন্তান জন্ম নিত জোড়ায় জোড়ায়। প্রতি জোড়ায় একজন ছেলে আর একজন মেয়ে। একই জোড়ার ছেলেমেয়ে পরস্পরে বিয়ে করতে পারে না। তাই কেউ বিয়ে করার ইচ্ছে করলে ভিন্ন জোড়ার ছেলে ভিন্ন জোড়ার মেয়েকে বিয়ে করত। এটাই ছিল নিয়ম। তাদের দুই পুত্র কাবিল ও হাবিল। কাবিলের জোড়া বোন ‘আকলিমা’ বেশ সুন্দরী ছিল। আর হাবিলের জোড়া বোন ‘গাযা’ সেই তুলনায় কম সুন্দরী ছিল। যদি বিবাহ করতে চায় তবে নিয়ম মতো একজন আরেকজনের জোড়ার মেয়েকে বিয়ে করবে।

নিয়ম অনুসারে হাবিল অধিক সুন্দরী আকলিমাকে বিয়ে করার কথা আর কাবিল বিয়ে করবে কম সুন্দরী গাযাকে। কিন্তু কাবিল নারাজ। সে হাবিলের জোড়ার গাযাকে বিয়ে করবে না। নাছোড়বান্দা কাবিল নিজের জোড়ার সুন্দরী বোন আকলিমাকেই বিয়ে করবে। কাবিল তার বোন আকলিমাকে বিয়ে করতে দেবে না হাবিলকে। এহেন পরিস্থিতিতে পিতা হজরত আদম (আ.) তাদের দু’জনকে আল্লাহর নামে কোরবানি দিতে বললেন। যার কোরবানি আল্লাহ গ্রহণ করবেন, তার ইচ্ছা মোতাবেক বিয়ে হবে বলে জানিয়ে দিলেন।

তৎকালীন সময়ের কোরবানি এখনকার কোরবানির মতো ছিল না। সে সময় কোরবানির বস্তুকে ভূমি থেকে ওপরে কোনো স্থান বা পাহাড়ে রাখা হতো, আর আকাশ থেকে আগুন এসে যদি সে বস্তুকে পুড়িয়ে দিত, তাহলে বোঝা যেত আল্লাহ কর্তৃক কোরবানি গৃহীত হয়েছে। আর যা পোড়ানো হতো না, তা কবুল হয়নি বলে জানা হতো। আদম (আ.)-এর দেওয়া মীমাংসা অনুসারে তারা উভয়েই কোরবানির বস্তু উপস্থাপন করল। হাবিল একটি সুস্থ ও মোটাতাজা দুম্বা কোরবানি করল এবং কাবিল তার কিছু সবজি ও শস্য কোরবানি করল। আল্লাহ হাবিলের কোরবানিকেই কবুল করেছিলেন। ওপর থেকে আগুন দিয়ে দুম্বাটিকে পুড়িয়ে নিলেন; কিন্তু কাবিলের শস্যকে পোড়ালেন না।

সে হিসেবে বিয়ের নিয়ম আগের মতোই রইল। হাবিল বিয়ে করবে কাবিলের জোড়ায় জন্ম নেওয়া আকলিমাকে। আর কাবিল বিয়ে করবে হাবিলের জোড়ায় জন্ম নেওয়া গাযাকে। কিন্তু কাবিল কোরবানি কবুল না হওয়ার অপমান সহ্য করতে পারল না। সে ভাবল, হাবিলের জন্য তার কোরবানি আল্লাহ গ্রহণ করেননি এবং কাক্সিক্ষত আকলিমাকে স্ত্রী হিসেবে না পাওয়ায় সে প্রচণ্ড রেগে গেল। হিংসায় ফেটে পড়ল। রাগের বশে হাবিলকে সে বলল, ‘কোনোভাবেই আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করতে দেব না। প্রয়োজনে আমি তোমাকে হত্যা করব। যেন তুমি আকলিমাকে বিয়ে করতে না পারো।’ জ্ঞানীজনরা বলেন, কাবিলকে পাপিষ্ঠ ইবলিস শয়তান এমন ধ্বংসাত্মক উসকানি দিয়েছিল।

কাবিলের এমন আচরণে হাবিল চমৎকার উত্তর দিয়েছিল। সে বলেছিল, ‘আল্লাহ তাদের কোরবানিই কবুল করেন যার উদ্দেশ্য হয় সৎ। আর তুমি আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আমার গায়ে আঘাত করলেও, আমি তোমাকে কিছু বলব না। কারণ আমি আমার আল্লাহকে ভয় করি।’ এসব কথায় কাবিলের উদ্দেশ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। হিংসার আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। রাগের বশবর্তী হয়ে সে আপন ভাই হাবিলকে হত্যা করল।

এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা সুরা মায়েদায় এরশাদ করেন, ‘আপনি তাদের আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শোনান। যখন তারা উভয়েই কিছু উৎসর্গ নিবেদন করেছিল, তখন তাদের একজনের উৎসর্গ গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের গৃহীত হয়নি। সে বলল- আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। সে বলল- আল্লাহ ধর্মভীরুদের পক্ষ থেকেই তো গ্রহণ করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা, আমি বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অতঃপর তুমি দোজখিদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি। অতঃপর তার অন্তর তাকে ভ্রাতৃহত্যায় উদ্বুদ্ধ করল। অনন্তর সে তাকে হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ (সুরা মায়েদা : ২৭-৩০)।

হিংসা-ক্রোধ-রাগ এসব ধ্বংসাত্মক উসকানি আসে সরাসরি শয়তানের কাছ থেকে। হিংসাই হচ্ছে আসমান ও জমিনের প্রথম পাপ। যার পেছনে ইন্ধনদাতা ছিল পাপিষ্ঠ ইবলিস শয়তান। আল্লাহতায়ালা নিবীজিকে বলেছেন, ‘আপনি আমার কাছে আশ্রয় চান হিংসা থেকে, যখন হিংসুকরা হিংসা করে।’ (সুরা ফালাক : ৫)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, হিংসা নেকিকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয়, যেভাবে আগুন শুকনো কাঠকে জ্বালিয়ে দেয়।’ আরেক হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পরকে হিংসা করো না। একে অপরের প্রতি বিদ্বেষভাব রেখো না। একজন আরেকজন থেকে আলাদা হয়ো না। বরং তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (মুসলিম)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত