ঢাকা শনিবার, ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তাকবিরে তাশরিক : ফাজায়েল ও মাসায়েল

মুফতি ইমামুদ্দীন সুলতান
তাকবিরে তাশরিক : ফাজায়েল ও মাসায়েল

জিলহজ মাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হলো ‘তাকবিরে তাশরিক’। তাকবির দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করা। শিরকের পাপ থেকে নিজেকে পবিত্র রেখে সর্বদা তাওহিদের চেতনায় উজ্জীবিত থাকা। একজন মোমিনের জন্য এটা সব সময়ের আমল। কিন্তু আল্লাহতায়ালা নির্দিষ্ট কিছু সময়ে বিশেষভাবে তাঁর বড়ত্বের কথা ঘোষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আইয়্যামে তাশরিক এমনই একটি সময়। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন- ‘তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ কর।’ (সুরা বাকারা : ২০৩)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এখানে নির্দিষ্ট দিনগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য- তাকবিরে তাশরিক পাঠের দিনগুলো। (বোখারি, মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, হাদিস-১০৮৭২)। অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন : ‘আইয়ামে তাশরিক পানাহার ও আল্লাহর জিকিরের জন্য।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২০৭২২)।

‘আইয়্যামে তাশরিক’ নামকরণের কারণ

তাশরিক শব্দের এক অর্থ হলো, রোদে গোশত শুকানো। এই দিনগুলোকে তাশরিক বলার কারণ হলো, আগের জমানায়া মানুষ এই দিনগুলোতে কোরবানির গোশতকে টুকরো টুকরো করে রোদে শুকাত। তাই এই অর্থের বিবেচনায় এই দিনগুলোকে আইয়্যামে তাশরিক বলা হয়। (ফাতওয়ায়ে শামি-২/১৭৭ সায়িদ, ফাতহুল কাদির-২/৪৮ রশিদিয়া)। কোনো কোনো ওলামায়ে কেরামের মতে ঈদের নামাজ এবং কোরবানির দিনকেও তাশরিক বলা হয়। কেননা ঈদের নামাজ ওই সময় আদায় করা হয় যখন সূর্য তাশরিক তথা আলোকিত হয়। (ফাতহুল কাদির-২/৪৮ রশিদিয়া)।

তাকবিরে তাশরিকের বাক্য

তাকবিরে তাশরিকের বাক্য ও শব্দমালা নিয়ে রেওয়ায়েতর ভিন্নতা রয়েছে। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ বর্ণনা হলো, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’ অর্থাৎ শুরুতে দুইবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। হানাফি, মালেকি, হাম্বলি মাজহাবের মত অনুযায়ী উপরোক্ত নিয়মে তাকবিরে তাশিরক বলা উত্তম। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৫৬৫১, ইলাউস সুনান-৮/১৫৬)। অব্যশ্য ভিন্ন রেওয়াতে শুরুতে তিনবার আল্লাহু আকবার বলাসহ ভিন্ন পদ্ধতির কথাও উল্লেখ রয়েছে। তাই হাদিসে বর্ণিত যেকোনো এক পদ্ধতিতে পড়লেই তাকবিরে তাশরিকের হক আদায় হয়ে যাবে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি কাম্য নয়। (দারাকুতনি-১৮২, তারিখে বাগদাদণ্ড১০/২৩৮,আসসুনানুল কুবরা লিল ইমাম বাইহাকি : ৬৫০৪)।

তাকবিরে তাশরিকের ইতিহাস

তাকবিরে তাশরিকের একটি ইতিহাস ফুকাহায়ে কেরাম উল্লেখ করেন। সেখানে তারা বলেন জিবরাইল (আ.) যখন দেখলেন ইবরাহিম (আ.) পুত্র ইসমাইলকে জবেহ করার উপক্রম, তখন জিবরাইল (আ.) আশ্চর্য হয়ে দুইবার আল্লাহু আকবর বলেন। এর পর ইবরহিম (আ.) জিবরিলকে দেখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহ আকবর’ বলেন। অতঃপর ইসমাইল (আ.) যখন জান্নাত থেকে দুম্বা আসার বিষয়টি জানতে পারলেন তখন তিনি ‘আল্লাহ আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ বলেন’। (বাহরুর রায়েক-২/১৬৫)।

ফুকাহায়ে কেরাম তাকবিরে তাশরিকের যে ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন রেওয়ায়েতে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।

তাকবিরে তাশরিক পড়ার হুকুম ও সময়

৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পর প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরষ মুকিম হোক বা মুসাফির, একাকী নামাজ পড়ুক বা জামাতে, ফরজ সালাতের পর একবার তাকবিরে তাশরিক বলা হানাফি মাজহাব মতে ওয়াজিব। এ তাকবির পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর পড়বে। অবশ্য গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী ঈদের নামাজের পর পড়বে। (দুররুল মুখতার-৩/৬৪ যাকারিয়া, ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া-২/৬৪৩ যাকারিয়া)।

হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত; নবী কারিম (সা.) আরাফার দিন তথা ৯ জিলহজ ফজর নামাজের থেকে আইয়ামে তাশরিকের শেষ দিন তথা ১৩ জিলহজ আসরের নামাজের পর পর্যন্ত ফরজের সালাম ফিরানোর পর তাকবিরে তাশরিক পড়তেন। (সুনানে দারা কুতনি-২/৩৭ হাদিস নং-১৭১৯, বায়রুত)।

আবু ইসহাক (রহ.) বর্ণনা করেন, আরাফার দিন ফজরের নামাজের পর থেকে তাকবিরে তাশরিক শুরু হওয়ার ব্যাপারে হজরত ওমর, হজরত আলী ও হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) একমত হয়েছেন। হজরত ওমর ও হজরত আলী (রা.) ১৩ তারিখ আসর নামাজের পর পর্যন্ত তাকবিরে তাশরিক পড়তেন। (আসসুনানুল কুবরা লিল ইমাম বাইহাকি : ৬২৭৪)।

ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়াতে উল্লেখ আছে, ‘তাকবিরে তাশরিক ওয়াজিব। শুরু হবে ইয়াওমে আরাফাহ তথা ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত। এই আইয়্যামে তাশরিকে যাদের উপর নামাজ ফরজ তাদের ওপর এই তাকবির ওয়াজিব। (ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া-২/৬৩৪-৬৪০ যাকারিয়া)।

তাকবিরে তাশরিক পড়ার পদ্ধতি

তাকবিরে তাশরিক ওই পাঁচ দিনে ফরজ নামাজের সালাম ফিরানোর পরপরই পড়া ওয়াজিব। সালামের পর নামাজ পরিপন্থি কোনো কোনো কাজ করার আগেই তাকবির পড়তে হবে। কেননা, এটা নামাজের সঙ্গে খাস। তাই কেউ যদি তাকবির না পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে যায় অথবা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কথা বলে বা ইচ্ছাকৃত হদস করে কিংবা নামাজ পরিপন্থি কোনো কাজ করে ফেলে, তাহলে তার থেকে তাকবির পড়ার বিধান রহিত হয়ে যায় এবং তাকবির না পড়র দরুন গোনাহগার হয়। (ফাতওয়ায়ে শামি-৩/৬১-৬৩ যাকারিয়া, বাহরুর রায়েক-২/১৬৫)।

তাকবিরে তাশরিকের মাসায়েল

মাসুবুক ব্যক্তি যে নামাজের কিছু অংশ পায়নি, সে তার ছুটে যাওয়া নামাজ শেষে সালাম ফেরানোর পর পড়ে নেবে। একাকী নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও পড়তে হবে। (রদ্দুল মুহতার-২/১৮০,মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৪/২৩৯)

তাকবিরে তাশরিক শুধু আইয়্যামে তাশরিকের দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সঙ্গে নির্দিষ্ট। এই দিনগুলোর বিতর বা অন্য কোনো সুন্নত কিংবা নফল নামাজের পর তা পড়ার বিধান নেই। অবশ্য গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী ঈদের নামাজের পর পড়বে (বাহরুর রায়েক-২/১৬৫, রদ্দুল মুহতার-৩/৬৩ যাকারিয়া, হিন্দিয়া-১/৩৭০)।

আইয়্যামে তাশরিকের আগের কোন নামাজ এই দিনগুলোতে কাজা করলে বা এই দিনগুলোর কোনো নামাজ আইয়্যামে তাশরিকের পরে কাজা করলে তখন তাকবিরে তাশরিক পড়ার বিধান নেই। অবশ্য এই দিনগুলোর কোনো ফরজ নামাজ যথাসময়ে পড়তে না পেরে এই দিনগুলোর অন্য কোনো দিন কাজা করলে তখন তাকবির পড়তে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে-১/৪৪৬, রদ্দুল মুহতার-২/১৭৯)।

তাকবিরে তাশরিক পুরুষরা উচ্চ আওয়াজে আর নারীরা নিম্ন আওয়াজ তথা নিজে শুনতে পায় এমন আওয়াজে পড়বে। পুরুষরা নিম্ন আওয়াজে পড়লে তাকবিরে তাশরিক পড়ার হক আদায় হবে না। (ফাতওায়ে হিন্দিয়া-১/১৫২ যাকারিয়া, হিন্দিয়া-১/১৫২ যাকারিয়া)।

তাকবিরে তাশরিক কোনো কারণে পড়তে না পারলে তা আর কাজা করার সুযোগ নেই । অনিচ্ছায় তাকবির ছুটে গেলে গোনাহ হবে না, তবে ইচ্ছাকৃত না পড়লে গোনাহগার হবে। তাই এর জন্য আল্লহতায়ালার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। (বাহরুর রায়েক-২/১৬৫, বাদায়েউস সানায়ে-১/১৯৬)।

ঈদগাহে যাওয়া-আসার সময় তাকবির পাঠ করা সুন্নত। তেমনিভাবে ঈদে নামাজের প্রথম খুতবায় ৯ বার ও দ্বিতীয় খুতবায় ৭ বার তাকবির বলা মুস্তাহাব। ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া-১/৩৬৬, রদ্দুল মুহতার-২/১৭৫)।

তাকবিরে তাশরিক কয়বার বলা সুন্নত

আইয়্যামে তাশরিকসহ জিলহজ মাসের প্রথম দশকে কোরআন ও হাদিসে বেশি বেশি তাকবির পড়ার কথা রয়েছে। তাই এই দিনগুলোতে যথাসম্ভব বেশি বেশি তাকবির পড়া চাই। কিন্তু কথা হলো, আইয়্যামে তাশরিকে ফরজ নামাজের পর তাকবির পড়ার যে বিধান সেক্ষেত্রে কতবার তাকবির পড়বে? একবার নাকি তিনবার? অনেকে বলে তিনবার বলতে হবে। তাদের এই ধারণা সঠিক নয়; বরং এক্ষেত্রে শুধু একবার তাকবির বলা ওয়াজিব। তিনবার পড়তে হবে এমন কোনো কথা হাদিসে বর্ণিত নেই। তাই একবার পড়াই সুন্নাহ সমর্থিত। শরিয়তের বিধান যেখানে যতটুকু সেখানে ততটুকুই পালন করতে হবে। কমবেশি করার সুযোগ নেই। তাই ফরজ নামাজের পর একবার (পুরুষরা) উচ্চ আওয়াজে তাকবির পড়বে। এর পর চাইলে সে নিম্ন আওয়াজে তিনবার বা আরও বেশি পড়তে পারে। তবে তিনবার পড়াকে সুন্নত মনে করা যাবে না। অন্যথায় তা মাকরুহ হবে। (ফাতওয়ায়ে শামি-৩/৬১-৬২, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া-১/১০২, হেদায়া-১/১৭৫)। অতএব, আইয়্যামে তাশরিকসহ প্রতিটি দিন এবং প্রতিটি মুহূর্ত তাওহিদি চেতনায় উজ্জীবিত হোক প্রতিটি মোমিনের হৃদয়। তাকবির, তাহলিল আর তাসবিহে কাটুক আমাদের সময়।

লেখক : মুহাদ্দিস-জামিয়া ইমদাদিয়া

আরাবিয়া, শেখেরচর, নরসিংদী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত