আমরা জানি, আল্লাহতায়ালা চাইলেই শুধু কোনো ব্যক্তি সন্তান লাভ করতে পারেন। তাঁর অনুগ্রহ ব্যতীত কেউ সন্তানের আশা পোষণ করতে পারে না। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের এ যুগল (দম্পতি) থেকেই তিনি তোমাদের পুত্র-পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তোমাদের উত্তম রিজিক দান করেছেন। এর পরেও কি তারা বাতিলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করবে? (সুরা নাহল : ৭২)।
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা শাওকানী (রহ.) বলেন, এ আয়াতের মর্ম হলো, আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের নিজস্ব প্রজাতির মধ্য থেকেই জোড়া বানিয়েছেন, যেন তোমরা তার সঙ্গে অন্তরের সম্পর্কের ভিত্তিতে মিলিত হতে পারো। কারণ প্রত্যেক প্রজাতিই তার স্বজাতীর প্রতি মনের আকর্ষণ বোধ করে থাকে। আর ভিন্ন প্রজাতির প্রতি তার মনে অনুরূপ আকর্ষণ থাকে না। মনের এ আকর্ষণ ও বিশেষ সম্পর্কের কারণেই বংশ বৃদ্ধি হয়ে থাকে। আর স্বামী-স্ত্রীর আবেগ উচ্ছ্বাসপূর্ণ প্রেমণ্ডভালোবাসা পরিপূর্ণতা লাভ করে সন্তানের মাধ্যমেই। সন্তান হচ্ছে দাম্পত্য জীবনের নিষ্কলঙ্ক পুষ্প বিশেষ। এ ব্যাপারে আল্লামা আলুসী (রহ.) বলেন, ধন-সম্পদ হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায় আর সন্তান-সন্ততি হচ্ছে বংশ তথা মানব প্রজাতি রক্ষার মাধ্যম।
পৃথিবীর বুকে এমন অসংখ্য মানুষ রয়েছে যাদের ধন-সম্পদের অভাব না থাকলেও একটি সন্তান না থাকার কারণে তাদের পারিবারিক জীবনে প্রশান্তি নেই। নেই বংশ বৃদ্ধির অবলম্বন। তাদের হাজারো চেষ্টা সাধনা এবং কামনা বাসনা থাকলেও সন্তানের জনক বা জননী হতে পারেনি তারা। আবার এমনও রয়েছে, যাদের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সম্পদ না থাকলেও তারা বহু সংখ্যক সন্তানের জনক-জননী। তাই বলতে হয়, সন্তান হওয়া না হওয়াও আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত। এ জন্যই আল্লাহতায়ালা বলেন, আকাশমণ্ডলী এবং পৃথিবীর রাজত্ব একমাত্র আল্লাহতায়ালার জন্যই। তিনি যা ইচ্ছা তা সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন অথবা দান করেন পুত্র-কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ এবং ক্ষমতাশীল। (সুরা শূরা : ৪৯-৫০)।
আলোচ্য আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, মানুষ যতই বৈষয়িক শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হোক না কেন, ইচ্ছেমতো সন্তান জন্মানোর ক্ষমতা তাদের নেই। অন্যদের সন্তান দানের কল্পনা করার তো প্রশ্নই আসে না। তাই চাইলেই পুত্র সন্তান বা কন্যাসন্তান পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে সব সৃষ্টিই অক্ষম। অতএব আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকে সন্তান দানের ক্ষমতার মালিক মনে করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলামসম্মত তো নয়ই। এমন ধারণা শিরক।
আমরা কেমন সন্তানের আশা করব সেটিও আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন তিনি সুসন্তান লাভের দোয়া শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন, তোমরা আমার দরবারে এভাবে দোয়া করো, ‘হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততি দান কর যারা হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং আমাদেরকে মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণযোগ্য কর।’ (সুরা ফুরকান : ৭৪)। তিনি আরও দোয়া শিক্ষা দিয়ে বলেন, ‘হে আমার রব! আমাকে তোমার কাছ থেকে সৎ বংশধর দান কর।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩৮)।
সন্তান আল্লাহতায়ালার দেয়া বিশেষ নেয়ামত। তাই এ সন্তান যদি হয় আদর্শ এবং সৎ চরিত্রের অধিকারী, তবে তা হবে পিতামাতার জন্য দুনিয়া এবং আখেরাতে কল্যাণের মাধ্যম। আর যদি সন্তান হয় অসৎ চরিত্রের অধিকারী, তাহলে এটি হবে অকল্যাণের বিষধর সাপের মতো। সৎ সন্তানের সুফল মৃত্যুর পরেও ভোগ করা যায়। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিন ধরনের আমলের ফলাফল সে ভোগ করে। তার মধ্যে একটি হলো, এমন সচ্চরিত্রবান সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ তাই আমাদের উচিত সন্তানকে সৎ এবং চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলা।
বিশ্বমানবতার মহান শিক্ষক, আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) শিশুদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। গভীর মায়ার আদরে শিশুদের কাছে টেনে নিতেন একান্ত আপন করে। আল্লাহর ভালোবাসা যেমন সর্বজনীন, ঠিক তেমনি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অকৃত্রিম ভালোবাসাও ছিল সর্বজনীন। হাদিসে এসেছে, একবার রাসুল (সা.)-এর কানে হুসাইন (রা.)-এর কান্নার শব্দ এলো। এতে তিনি ভীষণভাবে ব্যথিত হলেন এবং হজরত ফাতেমাকে (রা.) ডেকে বললেন, তুমি কি জান না, তার কান্না আমাকে কষ্ট দেয়?
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিস থেকে জানা যায়, রাসুল (সা.) শিশু-কিশোদের কাছ দিয়ে যাতায়াতের সময় তাদেরকে সালাম করতেন। অপর এক হাদিস থেকে জানা যায় যে, তিনি শিশুদের কান্না শুনতে পেলে নামাজ সংক্ষিপ্ত করে দিতেন এবং বলতেন, আমি চাই না যে, তার মায়ের কষ্ট হোক। তিনি আরও বলেন, যারা বড়দের সম্মান করে না এবং ছোটদের আদর করে না তারা আমার উম্মাতের দলভুক্ত নয়। আলোচ্য আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, শিশু-কিশোরদেরকে আদর এবং ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলতে রাসুল (সা.) এর জোরালো তাকিদ ছিল। শিশুদের সঙ্গে অসৎ ব্যবহার করা নিষেধ। তাদের মনে কষ্ট দেয়া যাবে না। তারা প্রস্ফুটিত ফুল।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের কর্ণধার। আদর্শিক পরিবার, দেশ ও জাতি গঠন করতে হলে শিশুদের চরিত্র গঠনে মনোযোগী হতে হবে। শিশুদেরকে আদর্শ ও চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে না পারলে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে যথাযথ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে না। তাই কোরআন ও হাদিসে শিশুদের চরিত্র গঠনের ব্যাপারে জোর তাকিদ দেয়া হয়েছে। শিশুদেরকে উত্তম চরিত্রের প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। অসৎ চরিত্রের প্রতি তাদেরকে ঘৃণার মনোভাব জাগাতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে পিতামাতাকে। তাই শিশুদের মাঝে আল্লাহ, রাসুল, কোরআন, হাদিস, পরকালে বিশ্বাস, জান্নাত-জাহান্নামের প্রতি আস্থা তৈরি তথা ইসলামি আদর্শের প্রতি যত্নশীল মনোভাব গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। অন্যদিকে অহংকার, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, গিবত, হিংসা-বিদ্বেষসহ খারাপ আদর্শের প্রতি বিরূপ মনোভাব গড়তে চেষ্টা করতে হবে।
সন্তানের চরিত্র গঠনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে রাসুল (সা.) বলেছেন, কারও সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সে যেন তার জন্য সুন্দর নাম রাখে এবং উত্তমরূপে তাকে আদব কায়দা, শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়। শিশুদের চরিত্র গঠনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, প্রতিটি শিশুই ফিতরাত তথা ইসলাম গ্রহণের যোগ্যতাসহ জন্মগ্রহণ করে। তারপর তার পিতামাতা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান অথবা অগ্নিপূজক বানায়। সন্তানের চরিত্র গঠনের গুরুত্ব বুঝতে হলে হজরত লুকমান (আ.) এর সন্তানের প্রতি অভিভাবকের নসিহত বা উপদেশগুলো জানতে হবে। তার নির্দেশিত উপদেশবাণী প্রতিটি পিতামাতার জানা থাকা জরুরি। সন্তানের চরিত্র গঠনের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, পিতামাতা সন্তানকে ভালো আদব-কায়দা ও স্বভাব-চরিত্র শিক্ষাদান অপেক্ষা উত্তম কোনো দান দিতে পারে না।
শিশুদের নিরাপত্তা বিধান এবং তাদের সার্বিক বিকাশ সাধনে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কার। শান্তি বা যুদ্ধ যে কোনো অবস্থায় ইসলাম শিশুদের নিরাপত্তা প্রদানে গুরুত্বারোপ করেছে। কাজেই পিতামাতা কোনো অবস্থাতেই সন্তানকে হত্যা করতে পারে না। সন্তানের কোনো ধরনের ক্ষতি হয়, এরকম কোনো কাজ পিতামাতাসহ কারও জন্যই ইসলামসম্মত নয়। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না। তাদেরকে আমিই রিজিক দিই এবং তোমাদেরকেও। তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ। (সুরা বনি ইসরাইল : ৩১)।
আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং প্রস্তর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোর স্বভাবের ফেরেশতারা! তারা আল্লাহতায়ালা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করেন না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করেন। (সুরা আত তাহরিম : ৬)।
মানুষের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। প্রতিটি মানুষ তার পরিবার রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল। তাকে এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর সম্পদ ও সন্তানের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। সে এসবের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। বর্তমানে বস্তুবাদী সমাজ পারিবারিক প্রথাবিরোধী সমাজ গঠনের কাজে বেশ সক্রিয়। এজন্য পশ্চিমা জাতির করুণ অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি। তাদের এ মানসিকতার কারণে তাদের জীবনে নেমে এসেছে চরম অশান্তি এবং বিপর্যয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের শান্তি, স্বস্তি এবং নিরাপত্তার জন্য পরিবার একটি দুর্গ। এ পরিবেশ ঠিক রাখতে হলে সন্তানকে আদর্শবান করে গড়ে তোলার বিকল্প কিছুই নেই। তাই সন্তান পরিপালনে আমাদের আরও যত্নশীল হওয়া জরুরি।
সন্তানের চরিত্র গঠনে সবচেয়ে বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবকের গুরুদায়িত্ব যিনি পালন করেন, তিনি হচ্ছেন মা। মায়ের আদর-সোহাগ এবং পরম ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে নবজাতক শিশুটি। শিশুর সুদণ্ডদুঃখ, হাসি-কান্না সব ক্ষেত্রেই মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। আমরা আরবি কবিতায় পড়েছিলাম ‘হিযনুল উম্মাহাত আল মাদরাসাতু লিল বানিনা ওয়াল বানাত।’ অর্থাৎ মায়ের কোলই হচ্ছে শিশুদের শিক্ষাকেন্দ্র। তাই যে মায়ের আদর্শে গড়ে উঠবে সন্তান, সে মাকে কেমন আদর্শ ও চরিত্রবান হওয়া দরকার! আজকে অনেকেই মেয়েদের শিক্ষা অর্জনের ব্যাপারে নাক ছিটকান। আমি এটাকে ভালো মনে করি না। মেয়েরা যদি আদর্শ এবং চরিত্রবান হিসেবে গড়ে ওঠে, তাহলে তারা জাতি গঠনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখতে পারবেন। তাই তো নেপোলিয়ন বলেছিলেন, তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, কুঁড়ি সাহিত্য সংসদ, ইসবপুর, সাদুল্লাপুর, গাইবান্ধা